Logo

শিক্ষা

কওমি ডিগ্রিধারীদের ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সময়ের দাবি

Icon

মুহাম্মদ হেদায়ত উল্লাহ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৮

কওমি ডিগ্রিধারীদের ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সময়ের দাবি

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা শুধুমাত্র বিশ্বাস বা ইবাদতের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতির নৈতিকতা, চরিত্র গঠন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষার মান যে হ্রাস পেয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োজিত আছেন, অনেকেরই উচ্চতর ধর্মীয় জ্ঞান নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাচ্ছে না; বরং অনেক সময় বিভ্রান্তির শিকারও হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসার দাওরা হাদিস ডিগ্রিধারী আলেমদের স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দাওরা হাদিস ডিগ্রি কোনো সাধারণ শিক্ষা নয়। এটি দীর্ঘ ১৬ থেকে ১৮ বছরের ধারাবাহিক ধর্মীয় ও দার্শনিক শিক্ষা। এ পাঠক্রমে ছাত্ররা ইসলামি আইন, তাফসির, হাদিস, আকিদা, আরবি ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং নৈতিক শিক্ষা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে। এই ডিগ্রিধারী আলেমরা কেবল ধর্ম জানেন না; তারা ধর্মের চেতনা ও দর্শনও ধারণ করেন। অতএব, তাদেরকে বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, যুক্তি এবং অনুপ্রেরণা—তিনটি একসঙ্গে লাভ করবে।

৭১ থেকে জুলাই, কওমি মাদ্রাসার ভূমিকা

১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার সময়, হানাদার বাহিনীর নজর এড়াতে তিনি আশ্রয় নেন চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়ে তাদের জন্য মেহমানখানা উন্মুক্ত করে। স্থাপন করা হয় অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র। শত্রু আক্রমণের আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত মাদ্রাসাটি ত্যাগ করেন।

পরবর্তীতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী প্রতিশোধ হিসেবে মাদ্রাসায় বোমা হামলা চালায়। এতে পুকুরপাড়ের ভবন ধসে পড়ে এবং শিক্ষক আল¬ামা আবদুল মান্নান দানিশসহ কয়েকজন শহীদ হন। ধ্বংস হয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ‘এদারাতুল মাআরিফ’-এর অফিস এবং বহু মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। আজও পটিয়া মাদ্রাসা দাঁড়িয়ে আছে, যুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়েই স্বাধীনতার ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে।

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অসাধারণ সাহস ও ত্যাগ প্রদর্শন করেন। তারা শুধু রাজপথে নয়, মানবিক, নৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। মানবিক সহায়তায় তারা আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দেন, পানি ও খাবার বিতরণ করেন, রাস্তা পরিষ্কার করেন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। সাংস্কৃতিকভাবেও অবদান রাখেন, যেমন ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ গ্রাফিতি। কওমি মাদ্রাসার এই ত্যাগ ও মানবিক ভূমিকা জুলাই আন্দোলনকে দেশপ্রেম, সাহস ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় করেছে।

সরকারের প্রতি আহ্বান

সরকার ইতোমধ্যে দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে স্বীকৃতির পূর্ণ প্রয়োগ তখনই অর্থবহ হবে, যখন এই ডিগ্রিধারীরা শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগে অংশ নিতে পারবেন।

দেশে ধর্মীয় শিক্ষার মানোন্নয়ন, তরুণ প্রজন্মের নৈতিক বিকাশ এবং সামাজিক শান্তির স্বার্থে অবিলম্বে এই উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দাওরা হাদিস ডিগ্রিধারীদের ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুধু ন্যায্য নয়, এটি সময়োপযোগী জাতীয় দায়িত্ব।

জাতি আজ নৈতিক অবক্ষয়ের মুখোমুখি। তা কাটাতে হলে ধর্মীয় শিক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে। এই শক্তির মূল উৎস আলেম সমাজূ যারা দাওরা হাদিসের পাঠে জ্ঞান, চরিত্র ও দায়িত্ববোধে সমৃদ্ধ। তাদের অন্তর্ভুক্তি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যেমন সমৃদ্ধ করবে, তেমনি জাতিকে ফিরিয়ে দেবে সেই মূল্যবোধ ও মনন, যার ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ একদিন এগিয়ে গিয়েছিল।

লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল (এম.এ) মাদ্রাসা

দশমিনা, পটুয়াখালী, বরিশাল

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর