ভারতবর্ষ বা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আলো পৌঁছে হজরত ওমর রাজি আল্লাহু আনহুর শাসনামলে। নিয়মন্ত্রিকভাবে ইসলামের বিজয় নিশান উড়ে বনী উমাইয়ার শাসনামলে বীর সেনানী মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের মাধ্যমে। সিন্ধু বিজয় হয় তখন। সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবেক গুরীর মাধ্যমে এ অঞ্চলে মুসলিম সালতানাতের সূচনা। হিজরি ৬ষ্ট শতাব্দীর শেষের দিকে শুরু মুসলিম শাসনামল। দীর্ঘ সাড়ে সাত শত বছর চলে এই শাসন। মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সময় অবসান ঘটে মুসলিম সালতানাত। সাড়ে সাত শত বছরে এই উপমহাদেশে গড়ে ওঠে শত শত মসজিদ, মাদরাসা। এই সময়ে দীনি শিক্ষার বৈশিষ্য ছিল,
ইসলামকে কেন্দ্র করেই ছিলো শিক্ষা। উলামায়ে কেরাম যে যাই করুন দীনি প্রচারে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সে সময় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো মাদরাসায়। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মসজিদে মসজিদে। ঘরে ঘরে ছিল শিক্ষার আয়োজন। পারিবারিক পরিবেশে মেয়েরা দীনি ইলম অর্জন করত। লাইব্রেরি, উলামায়ে কেরামের বাড়িতেও ছিল তালীমের বিশেষ আয়োজন।
মাদরাসাগুলোতে কর্মমুখী শিক্ষাও ছিল। সময়ের দাবিতে যা প্রয়োজনে তা ছিলো শিক্ষাব্যবস্থায়। ছিল বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, যুদ্ধবিদ্যাও ছিল পাঠ্যতালিকায়। স্থাপত্যবিদ্যা বা ফন্নে তামিরি, ক্যালিগ্রাফি বা খাত্তাতি শিক্ষার আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছিল বৈষয়িক প্রয়োজনীয় বিষয়াবলীর জন্য ছিলো মাদরাসা ও একাডেমি। এসব দ্বারা শিক্ষার ব্যাপকতা আন্দাজ করা যায়। অনুমেয় হয় কত উন্নত ছিল। সেই সময়ের শিক্ষা। ছিল বৈচিত্র। মাদরাসায় কুরআন হাদিস ফিকহ, মান্তেক, ইলমে কালাম যেমন ছি।, তার সঙ্গে ছিল ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, ভূগোলও। দীন ও দুনিয়ার সমন্বিত শিক্ষা ছিল প্রাচীন শিক্ষাব্যাবস্থায়। এইসব বিষয়ে প্রফেসর খোরশেদ আহমদ বিস্তারিত লিখেছেন তার গবেষণায়।
সুলতান মুহাম্মদ তুগলুক ১৩২৪-১৩৫১ ইসায়ী শাসনামলে শিক্ষা নিয়ে মাকরিজি বলেন, ‘‘সুলতান মুহাম্মদ তুগলুকের যুগে শুধু দিল্লিতেই এক হাজার (১০০০) ইসলামী বিদ্যাপীঠ মাদরাসা ছিল। ইমাম শাফী রহ এর মাযহাবভিত্তিক একটি মাদরাসাও ছিল। মুদাররিসীনদের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে তনখা বা মাহিনা (মাসিক বেতন) এর ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষা ছিল ব্যাপকতর। দাসি বাঁদিরাও হাফেযে কুরআন ছিল। এবং আলেমা হতেন। মাদরাসায় উলুমে দীনিয়ার সঙ্গে মাকুলাত ও রিয়াজি বা হিসাব বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হতো।’’
দিল্লির মাদরাসা ফিরোজশাহী বিষয়ে ইতিহাসবিদ জিয়া বরনি বলেন, ‘‘দিল্লির এই মাদরাসা শান শওকত, মনোরম ভবন, অবস্থানগত উন্নতি, সুব্যবস্থাপনা এবং সুশিক্ষা বিস্তারে ছিলো অনন্য। খরচের জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ ছিল। দিল্লির কোনো ভবন, ইমারত মাদরাসা ফিরোজশাহীর সঙ্গে তোলনা করা যেতো না। মাদরাসা ভবন ছিলো অতুল্য। মাদরাসার ভবন ছিল প্রশস্তময়। একটি মনোরম উদ্যানে পুকুরের পাড়ে ছিল। মাদরাসার ভবন। সুন্দততম পিরবেশে। সারাবেলা এখানে শিক্ষার্থী, আলেম এবং ইসলামিক স্কলার্স সরব থাকতেন পডালেখা ও গবেষণায়। শিক্ষা ভবন, আবাসিক ভবন ছিল। মনোরম পরিবেশে বাগানে বাগানে তালেবে ইলম ফুলেল পরিবেশে জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন থাকতেন।’’
বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বিদগ্ধ পশ্চিমা পর্যটক ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার হ্যামল্টন সফরনামায়ে সিন্দ ভ্রমণ বইয়ে ঠাট্টা শহর বিষয়ে লিখেন, ‘‘সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় সমৃদ্ধ চার শত মাদরাসা ছিল।’’ এইসব শুধু একটি দুটি শহরের কথা নয়, মুসলিম শাসনামলে শহরে নগরে গ্রামে পল্লিতে ছিলো মকতব মাদরাসা। ছিল উন্নত শিক্ষা। শিক্ষার মান ছিল উন্নত। সবার জন্য শিক্ষা ছিল।
প্রাচীন শিক্ষায় মুসলিম শাসকবর্গ শিক্ষায় আর্থিক সহযোগিতা করতেন তবে সিলেবাসে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সরকরার সহযোগী ছিল শিক্ষা বিস্তারে। দিল্লির শাসকদের এবং মোগল সালতানে ‘‘সদরুস সুদূর’’ একটি রাষ্ট্রীয় পদ ছিল। এই পদে শিক্ষাবিদ আলেম নিয়োগ হতেন। কাজ ছিল। তালিমী ও আখলাকি তদারকি স্বাধীন শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতেন না এই পদে সমাসীন হতেন যারা।
যোগ্য আলেম হলে বিচারক পদে নিয়োগ পেতন। পুরো শাসনামলে শিক্ষায় ছিল মুক্ত পরিবেশ। স্বাধীন পরিবেশ। সরকারি হস্তক্ষেপ বা নিয়তের কোনো মতলব ছিল না শাসকদের। প্রাচীন ভারতে দীনি শিক্ষা ছিল মুফত, ফ্রি। শিক্ষাবাণিজ্যের এই যুগে হয়তো কারোর কল্পনায় ধরবে না এমন সযোগ সুবিধা ছিল। সেই যুগে। মাদরাসা ও মসজিদে ছাত্রাবাস থাকত। আবাসন সুবিধা ফ্রিতে। খাবারের ফ্রি আয়োজন। শিক্ষার্থীদের ভাতা ও বৃত্তি দেওয়া হতো আমীরদের পক্ষ থেকে।
সেই যুগে তালেবে ইলমের সঙ্গে উস্তাযের সম্পর্ক ছিল পিতৃত্বের। উস্তাযজি হতেন মআল্লিম ও মুরব্বি। শিক্ষকের আখলাক, জ্ঞানপিপাসা, আত্মত্যাগ ছিল অনুপম। উস্তাযগণ তালেবে ইলমদের থাকা খাওয়ারও আয়োজন করতেন।
আসাতাযায়ে কেরামের সঙ্গে তালেবে ইলমদের তাযকিয়ার সম্পর্কও থাকতো। আধ্যাত্মিকতার উন্নতির চিন্তাও করতেন উস্তায। উস্তায চেষ্টা করতেন তালেবে ইলম যেন প্রকৃত মুসলিম হয়। ইসলামপ্রচারক হয়।
বিস্ময়কর বিষয়, সেই সময়ে মাদরাসাপড়–য়াগণ রাষ্ট্রের বড় বড় প্রশাসিনক পদে নিয়োগ পেয়ে জনসেবা করতেন। মাদরাসা শিক্ষায় রাষ্ট্রপরিচালনার দক্ষতাও শিক্ষা দেওয়া হতো। শিক্ষায় জুমুদ বা জড়তা ছিল না। সচল ছিল। ছিল সময়ের সঙ্গে, সময়ের আগে।
ডক্টর মাহমুদ আহমদ গাজি বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার অনন্য দিক হলো- নেজামে তালীম ও নেসাবে তালীম (শিক্ষা কারিকোলাম) আহলে ইলম (আলেমগণণ) তৈয়ার করতেন। শিক্ষা সেক্টরে দায়িত্বে থাকতেন উলামায়ে কেরাম। পার্থিক অপার্থিব তথা দীন ও দুনিয়ার সমন্বয়ের উজ্জল দৃষ্টান্ত সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশে সোনারগাঁয়ে শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ এর হাদিসের দরসগাহ এবং দারুল উলুম বা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একটি সোনালী অধ্যায়।
ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ এর শিক্ষাচিন্তা আরেক গৌরবময় অধ্যায়। মোল্লা নিজামুদ্দীন সাহালবী রহ এর দরস দরসে নেজামী অনন্য অধ্যায়। এইসব অধ্যায় গবেষণার বিষয়। চিন্তার দাবি রাখে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া, সাম্রাজ্যবাদীদের কালো অধ্যায় শুরু হওয়ার পর মুসলিমদের এবং তাদের গৌরবময় শিক্ষাব্যাবস্থার বিপর্যয়ের ইতিহাস। বিভক্তির ইতিহাস। আরেক কারবালর ইতিকথা। ব্রিটিশের কেরানি তৈয়ারের ফেক্টরিগুলো আজ সরগরম। চলছে শিক্ষাবাণিজ্য। চলছে শিক্ষায় পশ্চিমা প্রভাব। দেশ স্বাধীন হলেও শিক্ষা স্বাধীন নয়। স্বাধীন নয় আমাদের শিক্ষাচিন্তকরা। ব্রিটিশের ইতিহাস আলিয়া মাদরাসা তৈয়ারের ইতিহাস। ১৭৮০ সালে আলিয়া তৈয়ার করে তারা। আজকের আলিয়ার শিক্ষা ও অন্যান্য পরিবেশ দেখলে ব্রিটিশের কূটকৌশল চিন্তা সহজ হবে। স্কুল কলেজ ও ভার্সিটিতে সহশিক্ষার কুপ্রভাব, ছাত্র রাজনীতি, দাঙ্গা, ইভটিজিং এবং লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বেকারত্ব, যৌন হয়রানির চিত্র দেখলেই ব্রিটিশের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে লর্ডম্যাকলের কথা। কত সফলভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে ইসলামী ঐতিহ্যের শিক্ষা। স্বাধীনতার নামে আত্মিক গোলামীর কথা আমাদের সামনে।
ব্রিটিশের কবল থেকে দীর্ঘ শত বছর সংগ্রামের পর আল্লামা কাসেম নানুতবী রহ এবং তার সমচিন্তা নায়কগণ ভারতীয় মুসলিম ঐতিহ্য রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। দীনি দূর্গ। সংগ্রাম ও বিপ্লবের দূর্গ। ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব এখন বিশ্বময়। সীমানা ছাড়িয়ে শিক্ষায়, দীক্ষায় এবং দাওয়াহ কার্যক্রমে।
তবে একটি সরল কথা বলি, এই নেসাব এখন পুরনো সেই নেসাবে নেই। নেই মাকবলাতের অস্তিত্ব থাকলেও সমান্য। যুগের চাহিদা পূরণে কতটা সফল আজকের মাদরাসা শিক্ষা তা প্রকাশমান। সরকারি স্বীকৃতপ্রাপ্ত দাওরায়ে হাদিসের সনদে কি রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে কাজ করা যাবে? যাবে সেবা করা? ইমামতি, কাজিগিরি কি মাদরাসা শিক্ষা?
ওয়াজ ও মিম্বরের জায়গায় শুধু স্থান মাদরাসাপড়ুয়াদের! আবারও দীন দুনিয়ার সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা হোক দেশজুড়ে। আবারও মানকুলাতের সঙ্গে মাকুলাতের সমন্বয় হোক।
হোক দীনি মাদরাসার মানহাজ, নেসাব নেজাম একুশ শতকের চাহিদা বিবেচনা করে। সময়ের স্পন্দন, সময়ের ডাকে সাড়া দিবেন যুগের কলন্দর; সেই প্রত্যাশা। (লেখাটি ‘ইসলাম আওর নেজামে তালিম’ উর্দু কিতাব থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।)
লেখক : পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ

