গ্রামীণ জনপদ বাঙালির প্রথম পরিচয়। মাটির ঘ্রাণ আর প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা আমাদের সকালের সোনা রোদ গায়ে মাখা, পাখালির কিচিরমিচির। বিকালের হিমেল বাতাসে দোল খাওয়া। সন্ধ্যার আকাশে সেতারার ঝলমল। টিনের চালের ফাঁকে ঢোকা চাঁদের আলোকরশ্মি রাতের আরাম।
এসবই আমাদের সজীব রাখে অথবা আমরাই এই চেনামপ্রকৃতির সাথে মিশে যাই। আমাদের সহজে মিশতে পাড়া বা আপন কাজে প্রকৃতি আমাদের সাথে জড়িত থাকে প্রয়োজন পূরণে। তাই প্রকৃতির সাথে গ্রামীণ জনগণের চেয়ে ভালো সম্পর্ক আর কারো নেই।
সকালের মকতব বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের শত বছরের স্রোতধারা। আম্মার চায়ের কাপ ধুয়ে ধুয়ে ডাক আর আব্বার তেলাওয়াতের শেষ সুরের মূর্ছনাই মকতবে ছুটে চলার ঘণ্টা। ঘাসের বুকে জমে থাকা শিশিরবিন্দু ঠোঁটে মেখে হাসি আনন্দে ছুটে চলার আনন্দ শৈশবের সুখ।
আত্মার আত্মীয় মকতবের হুজুর। মকতবের ভাঙা ভাঙা পাঠে শেখা সুরায়ে ফাতেহা জীবনের দিকপাল। মৃদু মন্দ শাসনে হয় শিষ্টাচারের সবক। হৃদয়ে অংকুরিত হয় মকতব এক সোনালি অধ্যায়। মকতব শিক্ষা আর কওমী শিক্ষার প্রাথমিক স্তর একে অপরের সাথে মেশানো প্রায়। মকতব ও ইবতেদ্যায়ী মাদরাসার পরিবেশ, অবকাঠামো, শিক্ষার আবহ এবং শিক্ষকদের হৃদ্যতা একই বৃত্তের। দেশের প্রায় কওমি মাদরাসা গঠিত মকতব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, অধিকাংশ মাদরাসার সূচনাই হয়ে থাকে মসজিদে । মসজিদের মধ্যে কওমি মাদরাসার সূচনা হোক কিম্বা ছোট্ট কোনো টিনের ঘরে,এই মাদরাসাগুলো জন্ম নেওয়ার সাথে জড়িত থাকে গ্রামীণ জনপদের সর্বসাধারণ। উঁচু শ্রেণির মানুষের যেমন অংশগ্রহণ থাকে, তেমনি একদম খেটে খাওয়া মানুষের শ্রম সময়ও আন্তরিকতা থাকে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে।
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সৃষ্টির সাথে কিম্বা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার পথে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের তেমন একটা প্রভাব ও অংশগ্রহণ থাকে না,কিন্তু কওমি মাদরাসার সাথে তাদের এই বিচ্ছিন্নহীন সম্পর্কই হৃদয়ে এই শিক্ষার প্রতি অগাধ ভালোবাসার সঞ্চার করে।
কওমি মাদরাসার কুটির নির্মাণে গ্রামীণ জনপদের কমশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের শ্রম থাকে,থাকে হৃদয়ের প্রেম। যে মানুষটি নিজের নাম লিখতে জানে না, সেই মানুষ মাদরাসার আঙিনায় নিজের চলাফেরা, কাজকর্মের সাথে জড়িত থাকার কারণে তার মকতবপড়–য়া ছেলে এবং মেয়েকে এই মাদরাসায় পাঠানোর বাসনা মনের কোণে জাগায়। গ্রামীণ জনপদে প্রকৃতির মতো কাছের এবং আপন প্রতিষ্ঠান কওমি মাদরাসা। তারা আলো মাটি বাতাসের মতো প্রাণ পেয়ে থাকে এই কওমি মাদরাসা থেকে। কখনো নিজেদের ছোটখাটো প্রয়োজনে তারা ছুটে যায় মাদরাসার শিক্ষকদের নিকট আবার মাদরাসার ডাকে তাদের ছুটে চলা অবিরাম, কওমি মাদরাসার জরুরতে গ্রামীণ জনপদের সর্বসাধারণ নিজেদের উজাড় করে দেন। কওমি মাদরাসার উন্নতিতে গ্রামীণ জনপদের মানুষ সকলই স্ব স্ব জায়গা থেকে ভূমিকা রাখেন।
লেখক : কবি, গীতিকার, রাজনগর, মৌলভীবাজার

