Logo

শিক্ষা

ইলমে নববির সুবাসে ‘মিফতাহুল উলুম’

Icon

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৫২

ইলমে নববির সুবাসে ‘মিফতাহুল উলুম’

মানবজীবনে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামি শিক্ষা ও তাহজিব-তামাদ্দুনের (সভ্যতা-সংস্কৃতি) আলোতেই একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। কোরআন-হাদিসের শিক্ষা ছাড়া অধিকাংশ মানুষের ভেতরে মানবতা, মনুষ্যত্ব, সততা ও নৈতিক গুণাবলি বিকশিত হয় না। তাই দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করাকে ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দ্বীনি ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘সুতরাং তাদের প্রত্যেক দলের একটা অংশ কেন বের হয় না, যেন তারা দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সতর্ক করে স্বজাতিদের, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১২২)

প্রাচীনকাল থেকে বাংলার ইসলামি শিক্ষাধারার ইতিহাসে মাদরাসাগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ছোট গ্রামে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামি জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এমনই এক প্রাচীন গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হলো ‘চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদরাসা।’ ব্রিটিশদের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসা দীর্ঘ প্রায় নয় দশক ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দক্ষিণাঞ্চলের ধর্মপ্রাণ তাওহিদবাদী জনতার ইমানি চেতনায় আলো ছড়িয়ে আসছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

প্রতিষ্ঠার পটভূমি: মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিশিষ্ট বুজুর্গ আলেমে দ্বীন মাওলানা আব্দুল হাই (রহ.)। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ দ্বীনি দায়ি, যিনি সমাজে ইসলামী শিক্ষা প্রসারের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। তাঁর এই মহতী প্রচেষ্টার প্রেরণাদাতা ছিলেন তৎকালীন বাংলার আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলাম (রহ.)। মাদরাসার পাশ দিয়েই গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। একদিন ফখরে বাঙাল (রহ.) ট্রেনে ভ্রমণের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাই (রহ.)। পথিমধ্যে একটি স্থানের দিকে তাকিয়ে ফখরে বাঙাল (রহ.) বললেন, ‘আব্দুল হাই! আমি এখান থেকে ইলমের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। তুমি এখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করো।’ ফখরে বাঙাল (রহ.)-এর এই নির্দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে মাওলানা আব্দুল হাই (রহ.) ১৯৩৯ সালে ওই স্থানে একটি দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে ইসলামি শিক্ষার ধারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ ছিল অপ্রতুল। এমন পরিস্থিতিতে তার এই উদ্যোগ ছিল সময়োপযোগী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ।

নামকরণের অনন্য প্রেক্ষাপট: এই মাদরাসার নামকরণের পেছনে রয়েছে অত্যন্ত চমৎকার ও অনুপ্রেরণামূলক ইতিহাস, যা এর ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক মর্যাদাকে আরও সমুন্নত এবং সমৃদ্ধ করেছে। মাওলানা আব্দুল হাই (রহ.) ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলাম (রহ.)-এর অনুপ্রেরণায় প্রথমে মাদরাসাটির নাম রাখেন ‘তাজুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা।’ নামটি দেখে ফখরে বাঙাল (রহ.) নিজের নামটি কেটে দিয়ে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর নাম অনুসারে লিখলেন ‘শামসুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা।’  

পরে এই নামটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় ফরিদপুরী (রহ.)-এর কাছে। তিনি বিনয়ের সঙ্গে নিজের হাতে আগের নামটি কেটে লিখলেন, ‘চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা।’ মাদরাসাটি অদ্যাবধি এ নামেই নিজের পরিচয় বহন করছে।

শিক্ষা কার্যক্রম: প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই মাদরাসাটিতে ইসলামি শিক্ষার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। শুরুতে এখানে শুধুমাত্র নুরানি বিভাগে শিশুদের কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এতে যুক্ত হয় হিফজুল কোরআন বিভাগ এবং কিতাব বিভাগের পাঠক্রম। বর্তমানে মাদরাসাটিতে নুরানি, হিফজ ও কিতাব বিভাগের পাঠদান চলছে মিশকাত জামাত পর্যন্ত। পাঠ্যক্রম পরিচালিত হয় বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ড ‘এদারায়ে তালিমিয়া’র সিলেবাস অনুযায়ী। প্রতি বছর বেফাক ও এদারার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় এই মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে মেধাতালিকায় স্থান অর্জন করে আসছে। ফলে দিন দিন মাদরাসার সুনাম, মর্যাদা ও গৌরব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

ছাত্রদের অবদান: এই মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্ররা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা দ্বীনি মারকাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আলেম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুফতি ও দায়ি হিসেবে ইসলামের দাওয়াত ও জ্ঞান প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ। বিশিষ্ট আলেম ও রাজনীতিবিদ আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল এই মাদরাসা থেকেই, যা মাদরাসার ইতিহাসে এক গৌরবময় ও স্মরণীয় অধ্যায়।

সমাজিক অবদান: চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা গতানুগতিক কোনো শিক্ষাকেন্দ্র নয়, বরং সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও রয়েছে তার সক্রিয় ভূমিকা। বিশেষ করে বাতিল ও অন্যায়ের মোকাবেলায় এই প্রতিষ্ঠান বরাবরই সম্মুখ সারিতে অবস্থান করেছে। ২০০১ সালের ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী ছয়জন শহিদের একজন ছিলেন এই মাদরাসারই ছাত্র হাফেজ সাইফুল ইসলাম (রহ.)। স্থানীয় জনগণও এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষার জন্য এই মাদরাসায় ভর্তি করেন।

ঐতিহ্যের ধারক: আট দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত এই মাদরাসাটি আজও তার আদর্শ ও নীতিতে অটল। প্রযুক্তি, সভ্যতা ও আধুনিকতার যুগেও চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছে, যারা কোরআন-সুন্নাহর আলোয় সমাজকে আলোকিত করতে বদ্ধপরিকর।

ফখরে বাঙাল (রহ.) ও শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হাই (রহ.)-এর ত্যাগ, শিক্ষকদের নিষ্ঠা এবং ছাত্রদের পরিশ্রম—সব মিলিয়ে চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা এক উজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চান্দপুর মিফতাহুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা, সদর ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর