আমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ২০১৩ সালে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। প্রাক্-প্রাথমিকে নিয়োগ হওয়ার সুবাদে ছোট্ট শিশুদের সাথে খুব কাছ থেকে মেশার ও ওদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে আমার। আমি ওদের সাথে থেকে ওদের আচরণসমূহ পর্যবেক্ষণ করি। যা আমাকে অনেক সময় অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও করে তোলে। আমি যেমন ওদের সুবিকশিত মনোভাবে আপ্লুত হই, তেমনি কিছু সমস্যার বিপরীতেও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হই। তবে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো আমারই সমস্যা মনে হয়। তাই প্রচেষ্টা থাকে তা সমাধানের উপায় খুঁজতে।
বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় সৃজনশীল কাজগুলোকে। আর শিশুদের সার্বিক বিকাশে সৃজনশীলতার গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাথমিক শিক্ষায় সৃজনশীলতার গুরুত্বকে শীর্ষে রেখে এর আবশ্যিক প্রয়োগের ওপর জোর দেয়া হয়। আমি চেষ্টা করি সৃজনশীল কাজগুলোর সফল প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশকে ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে।
আমার জীবনের অন্যতম একটি শখ হলো ‘‘বাগান করা’’। তাই এ শখ পূরণ করতে আমাকে গাছ লাগানোর পদ্ধতি ও এর সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে জানতে হয়। আমার প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুরা আমার স্বপ্ন বাগানের ছোট প্রাণ। আমি তাই চেষ্টা করি ওদের মানসিক বিকাশে সহায়কের ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে যত্ন নেয়ার।
আজ ওরা সঠিক যত্ন পেলে, কাল ওরা প্রস্ফূটিত গোলাপের ন্যায় সুবাস ছড়াবে। আর যতেœর অভাবে ওরা পরিণত হতে পারে আগাছাতে। পারিবারিক, সামাজিক ও বিদ্যালয়ভিত্তিক সঠিক যত্ন পেলে শিশুকে সৃজনশীল কুঁড়িতে রূপান্তর করা সম্ভব।
যা আগামীতে প্রত্যয়ের সাথে সৌন্দর্য আর সুগন্ধ ছড়াবে। তাই আমাদের এজন্য সচেতনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে এবং যার যার ক্ষেত্র থেকে যথাযথ দায়িত্বশীলতার প্রমাণ রাখতে হবে।
আমি লক্ষ্য করেছি, আমার বিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধেক শিশুর পরিবারে পারিবারিক সমস্যাসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান। এক্ষেত্রে সিংহ ভাগ শিশুর শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব দেখা যায়। এর থেকে শিশুদের অনুপস্থিতি ও ঝরে পড়ার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। হয়তো আমরা শিশুদের পারিবারিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারব না, তবে শিশুর বিদ্যালয়ের পরিবেশে সৃজনশীল কাজের চর্চার মাধ্যমে মানসিক বিকাশে অবশ্যই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারব। আর এই বৃহদাকার সমস্যা সমাধানের অন্যতম মাধ্যম সৃজনশীল কাজ। এর বহুমুখী চর্চার মাধ্যমে উপস্থিতির হার বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝরে পড়ার মতো প্রধান সারির সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে সফল হওয়া সম্ভব।
যে সকল উপায়ে শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশে কাজ করা যায়-
১ মা ও অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে সৃজনশীল কাজের গুরুত্ব আলোচনা করা।
২. উঠান বৈঠকের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে সৃজনশীল কাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা।
৩. সদ্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের বিদ্যালয়ভীতি দূর ও বিদ্যালয়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়তে শিশুবরণ ও হাতেখড়ি উৎসব পরিচালনা করা।
৪. চারু ও কারু কলার কাজের অনুশীলন করা।
৫. ছড়া, গান, নাচ, গল্প বলা, অভিনয় অনুশীলন করা।
৬. শিশুদের শ্রেণিকক্ষ সৃজনশীল উপায়ে সজ্জিতকরণ করা।
৭. শিশুদের সৃজনশীল কাজগুলো অভিভাবক সমাবেশে প্রদর্শন করা।
৮. শিশুদের নিয়ে সৃজনশীল প্রজেক্ট পরিচালনা করা।
৯. এ লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
আমি আমার শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল কাজগুলোর সফল প্রয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান নানা সমস্যার সমাধানের সাথে এখন অনুপস্থিতির হার ও সেই সাথে ঝরে পড়ার হার শূন্য করতে সফল হয়েছি। যা একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে আত্মতুষ্টির বিষয়।
আমি চাই, আমার বাগানের এই সৃজনশীল কুঁড়িগুলোর প্রস্ফুটিত সুবাস আগামীতে ছড়িয়ে যাক দেশ পেরিয়ে বিশ্ব ভূমণ্ডলে।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, গোপীনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নগরকান্দা, ফরিদপুর

