Logo

শিক্ষা

চট্টগ্রামে ইসলামী জ্ঞানের প্রচার-প্রসার

Icon

মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫

চট্টগ্রামে ইসলামী জ্ঞানের প্রচার-প্রসার

ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে এবং আদর্শবান, চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের প্রথম বাণী হলো শিক্ষাবিষয়ক। ইসলামী শিক্ষা সাংস্কৃতির মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল ইসলামী ভাবধারা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরী না হওয়া পর্যন্ত মুসলিম শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় ও মজবুত হতে পারে না।

বঙ্গদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি অসমান্য অবদান রাখেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বলেন, বখতিয়ার খিলজি লখনৌতিতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি তাঁর রাজ্যের প্রত্যেকটি  এলাকায় প্রচুর মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন। 

মুহাদ্দিস শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা হাম্বলী বুখারী (রহ) হিজরী সপ্তম শতকের প্রারম্ভে ঢাকা জেলার সোনারগাঁওয়ে আগমন করেন। তিনি এখানে হাদীস চর্চা চালু এবং উচ্চ মানের মাদরাসা, খানেকাহ ও মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার সুযোগ্য ছাত্র ও জামাতা শায়খ শরফুদ্দীন আল মুনিরীও ব্যাপকভাবে হাদীস চর্চা ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটান। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বহু প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামেও প্রতিষ্ঠিত হয়।

চট্টগ্রামে মুসলিম শাসনামলে সর্বশেষ শাসনকর্তা হলেন নবাব মীর মুহাম্মদ রেজাখান (১৭৬০ খ্রী.)। তার হাত থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬১ সালে চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ। ইংরেজ আমলে ধর্মীয় শিক্ষা উপেক্ষিত হলেও ১৭৬১ সাল থেকে অদ্যাবধি চট্টগ্রামের সচেতন আলেম সমাজ, শিক্ষানুরাগী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় অনেক মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসা গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যায়ে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলার হিড়িক পড়ে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার নব জাগরণের সূচনা হয়।

কওমি ধারায় ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারী আল জামিয়া আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম। চট্টগ্রামের কওমি ধারার শীর্ষস্থানীয় কিছু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

আল জামিয়া আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলা সদরে দেশের সর্ব বৃহৎ এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সুযোগ্য শিষ্য মাওলানা হবীবুল্লাহ রহ. (১৮৬৫ খ্রী.- ১৯৪৩ খ্রী.) মাওলানা ফজলুর রহমান মুরাদাবাদী রহ. এর অন্যতম খলিফা মাওলানা আব্দুল ওয়াদেদ (১৮৫০ খ্রী.-১৯১০ খ্রী.), মাওলানা আব্দুল হামীদ (১৮৭০ খ্রী.- ১৯২০ খ্রী) ও মাওলানা সূফী আজিজুর রহমান (১৮৬২ খ্রী-১৯২১ খ্রী) প্রমুখ মনীষীদের অপ্রাণ প্রচেষ্টায় এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আল জামিয়া আল আরাবিয়া জিরি মাদরাসা

দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায়  এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। বৃহত্তর চট্টগ্রামে এটি দ্বিতীয় প্রাচীন কাওমী মাদরসা। হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল মাদরাসা ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ১৯১০ সালে জিরি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়। জিরির প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মাওলানা আহমদ হাছন (রহ) এর অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। 

আল জামিয়া আল ইসলামিয়া জমীরিয়া কাসেমুল উলুম

দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায়  এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। চরকানাই নিবাসী প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও বুজুর্গ মুফতী আজীজুল হক (১৯০৫ খ্রী- ১৯৬১ খ্রী) স্বীয় মুর্শিদ মাওলানা জমীর উদ্দীনের পরামর্শ ও নির্দেশনা মোতাবেক ১৯৩৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। 

আল জামিয়াতুল হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম মাদরাসা হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামীদ (রহ) জীবনের শেষ বয়সে ১৯১৭ সালে হাটহাজারীস্থ ফতেহপুর এলাকায় হাটহাজারী সড়ক সংলগ্নে এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এবং আমৃত্যু তিনিই মুুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। 

আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম

বন্দরনগর চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরে ফটিকছড়ি উপজেলাধীন ‘বাবুনগর’ গ্রামে মাদরাসাটি অবস্থিত। হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (রহ) ও মাওলানা ফজলুর রহমান গাঞ্জেমুরোদাবাদি (রহ) এর খলিফা বোয়ালখালী নিবাসী মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ (রহ) হিন্দুস্থান থেকে দেশে ফিরে খান্দকিয়া এলাকায় একটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তিনি মাওলানা সূফী আজিজুর রহমান এর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে বাবুনগরে এসে বর্তমান মাদরাসার উত্তর-পূর্ব পাশে পরাতন মসজিদের পশ্চিম  পার্শ্বে একটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ (রহ) ইন্তেকাল করলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সে মকতব বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ১৯২২ সালে হযরত মাওলানা মুসা প্রকাশ বুজুর্গ সাহেব নিজ বাড়িতে এলাকার মুসলমানের ছেলে মেয়েদের শিক্ষাদান করতেন।পরে তিনি স্বীয় মুর্শিদ মাওলানা জমিরুদ্দিন (রহ) (১৮৭৮-১৯৪০) এর সাথে রেঙ্গুন এ চলে গেলে উক্ত মকতবের শিক্ষাক্রম বন্ধ হয়ে যায়। 

অতঃপর মুফতি আজিজুল হক (রহ) এর অন্যতম খলীফা মাওলানা শাহ হারুন বাবুনগরী (রহ) হাটহাজারী মাদরাসার আলেম-ওলামাদের পরামর্শক্রমে বর্তমান মাদরাসার পশ্চিম কোণে দু’চাল বিশিষ্ট একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। তার শায়খ মাওলানা আজিজুল হক  (রহ) বাবুনগর মাদরাসায় আগমন করলে মাদরসার নাম প্রসঙ্গে আলোচনা হয়লে তিনি “আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদরাসা” নামে নামকরণ করেন। বর্তমানে মাদরাসার নামের সাথে ‘আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া’ শব্দ সংযোজন করা হয়।

আল-জামিয়াতুল মাদানীয়া কাশেফুল উলুম মাদরাসা

এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র কোতায়ালী থানার অন্তর্গত শুলকবহর এলাকায় অবস্থিত। শুলকবহর নিবাসী জনাব মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম  ১৯৬৮ সালে এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদরাসার প্রথম মুহতামিম ছিলেন রাঙ্গুনিয়া নিবাসী মাওলানা মুহাম্মদ ইঊসমাঈল (রহ)। তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত  একটানা ২৯ বছর মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অত্র প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। 

আল জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া, লালখান বাজার

বাঁশখালী উপজেলাস্থ ঐতিহ্যবাহী এক চৌধুরী পরিবারের কৃতি সন্তান নেজামে পার্টির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুফতি ইজহারুল ইসলাম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের মাওলানা শওকত আলী রোডের লালখান বাজার পাহাড়ী এলাকায় ০৮ একর জমির উপর এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।

জামিআ দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া

আল্লামা সুলতান যওক নদভী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব,আরবি সাহিত্যিক ও প্রতিথযশা মুহাদ্দিস। তিনি কওমী ধারায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী যুগচাহিদা ও আধুনিক ধারায় উচ্চ  মান সম্পন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ),মাওলানা শাহ হারুন বাবুনগরী (রহ), মাওলানা মুফতি নুরুল হক (রহ), বায়তুল মোকাররমের খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ) ও অধ্যক্ষ এ.এ. রেজাউল করিম চৌধুরী সহ অসংখ্য আলেম ওলামা ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদগণের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে আল্লামা সুলতান যওক নদভী এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা আরম্ভ করেন।

১৪০৫ হিজরী ১৯৮৫ সালে দেওয়ান বাজার লেইনের মরহুম হাজী মোজাহেরুল ইসলাম সাহেবের মসজিদ সংলগ্ন ভাড়া বাসায় ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়।  পরবর্তীতে মুরাদপুরস্থ হাজী এয়াকুব সাহেবের চারতলা বিশিষ্ট ভবনের নিচতলা ভাড়া করে পাঠদান আরম্ভ হয়। এভাবে প্রায় ০৬ মাস মুরাদপুরে শিক্ষা কার্যক্রম চলার পরে চান্দগাঁও হাজীরপুলে মরহুম সূফী মুহাম্মদ মিয়া কতৃক প্রতিষ্ঠিত মুহাম্মদীয়া জমীরিয়া কাসেমুল উলূম নামে একটি মাদরাসা ছিল। সেখানে দারুল মা’আরিফ মাদরাসা স্থানান্তরিত করা হয়। আল্লামা সুলতান যওক নদভী সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় মাদরাসাটির প্রভৃতি উন্নতি সাধিত হয়। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘আল হক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

তাছাড়া চট্টগ্রামের প্রায়  প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  আছে। সেখানে  নানাভাবে ধর্মীয় ও সামজিক ও রাষ্ট্রীয় নানাক্ষেত্রে খেদমত আন্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক : কলামিস্ট ও সদস্য, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর