আল-মারকাজুল ইসলামী : শিক্ষা ও মানবসেবার অনন্য প্রতিষ্ঠান
নাজমুল হাসান সাকিব
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৫
বাংলাদেশে ‘মাদরাসা শিক্ষা’ এখন কেবল ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি আধুনিক সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই ধারায় আল-মারকাজুল ইসলামী (এ.এম.আই) এমন এক প্রতিষ্ঠান। যা একদিকে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে, অন্যদিকে মানবকল্যাণ ও সমাজসেবায় এক উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করেছে। বর্তমানে সংস্থাটির অধিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১২ টি মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ‘আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী (অন্ধ) মাদরাসা’। ১৯৮৮ সালে হাফেজ মাওলানা মুফতি শহিদুল ইসলাম (রহ.) এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ দাওয়াহ ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ‘শিক্ষা, সেবা, আত্মশুদ্ধি ও দাওয়াহ,’ এই চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আল-মারকাজুল ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
প্রতিষ্ঠাতা : আলোকিত দাঈ ও সমাজসংস্কারক আরেফ বিল্লাহ শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার রহ. এর খলীফা হাফেজ মাওলানা মুফতি শহিদুল ইসলাম (রহ.) ছিলেন একাধারে আলেম, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। ইসলামী শিক্ষা, সামাজিক সংস্কার ও মানবসেবায় অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। তার হাতে গড়া আল-মারকাজুল ইসলামী এখন হাজারো মানুষের প্রেরণার নাম। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেখানে কুরআনের শিক্ষা ও সমাজসেবা একসঙ্গে চলবে। তার সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেয়েছে। তার স্বপ্নে কেরাণীগঞ্জ সংস্থাটির একাডেমিক সিটি নির্মিত হয়েছে। যেখানে একাধারে কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্স সমমান, ইসলামী আইন ও গবেষণা এবং আরবি সাহিত্য বিভাগ চালু রয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, উন্মুক্ত ১০ তলা বিশিষ্ট সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ইত্যাদি।
আধুনিক ও ঐতিহ্যের সমন্বয় : আল-মারকাজুল ইসলামী পরিচালিত মাদরাসাগুলোতে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাও দেওয়া হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স সমমান দাওরায়ে হাদীস, ইফতা বা ইসলামী আইন ও গবেষণা, আদব বা আরবি সাহিত্য পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পায়। পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণও চালু রয়েছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ : ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা চালু করেছে। এর জন্য আলাদা আবাসিক বিভাগ রয়েছে। এখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা, অডিও পাঠ ও হাফেজি প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেছে। এটি বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ।
মানবতার পাশে আল-মারকাজুল ইসলামী : আল-মারকাজুল ইসলামী শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়— এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবকল্যাণ সংস্থা। কোভিড-১৯ এ সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাদরাসাসহ মোট ১২ টি মাদরাসা, কুরবানী প্রজেক্ট, বন্যা ও দুর্যোগকালীন ত্রাণ কার্যক্রম, রোহিঙ্গা পূনর্বাসন, কাফন-দাফন ও জানাযা সেবা ইত্যাদি কর্মসূচি।
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত অষ-গধৎশধুঁষ ওংষধসর ঐড়ংঢ়রঃধষ বর্তমানে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সজ্জিত। এখানে সবার জন্য স্বল্পমূল্যে আর দরিদ্র রোগীদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা ও এ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হয়।
ত্রাণ ও দুর্যোগ সহায়তা : বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও শীতবস্ত্র বিতরণ। প্রতিটি দুর্যোগেই আল-মারকাজুল ইসলামী তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে মাঠে থাকে। ফেনী,লক্ষ্মীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, বান্দরবনসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা নিয়মিতভাবে সেবা প্রদান করছে।
সমাজগঠন ও দাওয়াহ কার্যক্রম : ইসলামী চিন্তা ও সংস্কৃতির বিকাশে আল-মারকাজুল ইসলামী নিয়মিত সেমিনার, দাওয়াহ প্রোগ্রাম ও ইমাম ও কওমী শিক্ষক প্রশিক্ষণ আয়োজন করে থাকে। তাদের অধীনে পরিচালিত ‘ইমাম ও খতিব প্রশিক্ষণ একাডেমি’ দেশব্যাপী ধর্মীয় নেতৃত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আন্তর্জাতিক সেবা ও সম্পর্ক : আল-মারকাজুল ইসলামী এখন শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। আমেরিকার নিউইয়র্কে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কওমী মাদরাসা। এছাড়াও দেশের বাহিরে নানা সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সংস্থাটি। তুরস্ক, আফগানিস্থানসহ বিভিন্ন দেশের দূর্যোগে ত্রাণ সহযোগিতা পাঠিয়েছে তারা।
নারীদের ক্ষমতায়ন : প্রতিষ্ঠানটি “আল-মারকাজুল ইসলামী মহিলা শাখা” নামে পৃথক বিভাগ পরিচালনা করছে। এখানে প্রতিবছর ১৫০০ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইসলামী শিক্ষা, দাওয়াহ প্রশিক্ষণ, সেলাই-কাটিং ও হস্তশিল্প কোর্সের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে অনেক নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।
মিডিয়া ও প্রকাশনা বিভাগ : আল-মারকাজুল ইসলামী নিয়মিত ‘আল-ইহসান’ ইসলামী পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সাময়িক প্রিন্ট বন্ধ থাকলেও অনলাইন কনটেন্ট প্রকাশ করে। বিশেষ করে ওয়েবসাইট, ইউটিউব ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের দাওয়াহ বার্তা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
অন্ধ শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে দিচ্ছে আল-মারকাজুল ইসলামী : অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এখানে শুধু পড়াশোনা করে না, বরং আত্মবিশ্বাস অর্জন করে সমাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই হাফেজ, ক্বারী, এমনকি শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ‘অন্ধত্ব নয়, অজ্ঞতাই আসল অন্ধত্ব।’ এই নীতিবাক্যকে সামনে রেখে তারা ইসলামী শিক্ষাকে দৃষ্টিহীনদের জন্যও সহজলভ্য করেছে। ইতোমধ্যে ৫০০এরও অধিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এখান থেকে হিফজ সম্পন্ন করেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও আইটি এন্ড মিডিয়া অফিসার, আল-মারকাজুল ইসলামী (এ.এম.আই)

