শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা
প্রহার-বেত্রাঘাত তারবিয়াহর পদ্ধতি নয়
লাবীব আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৯
আমার জীবনে একজন উস্তায ছিলেন, যিনি কখনও কাউকে ধমক দেননি, এমনকি কোনো তালেবে ইলমকে প্রহারও করেননি। তবুও তালেবে ইলমরা তাকে অত্যন্ত সম্মান করত, আমরাও করতাম। আরেকজন উস্তায পেয়েছিলাম, যিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। অন্যদিকে, আরেকজন উস্তাযের কথা জানি, যিনি কথায় কথায় ধমক দিতেন এবং বেত্রাঘাত করতেন। তালেবে ইলমরা তাঁকে দেখলেই ভয় পেত।
আমার শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা দুই যুগেরও বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি শিক্ষাবিভাগের দায়িত্ব পালন করার তাওফীক পেয়েছি। আমি মহিলা মাদরাসা, ছেলেদের মাদরাসা এবং কিছুদিন কিন্ডারগার্টেনেও ক্লাস নিয়েছি। কর্মজীবনে নানা মেজাজ ও স্বভাবের শিক্ষকের সাক্ষাৎ পেয়েছি।
এক বদমেজাজি শিক্ষিকার কথা জানি, যার রাগ ছিল আগুনের মতো। তিনি বেত্রাঘাত করে নিজের রাগ শান্ত করতেন। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন, যাঁর মনে হত শিশুদের প্রহার না করলে তাঁর মন শান্ত হয় না। আমার কাছে তিনি মানসিক রোগী বলে মনে হত। অনেক তালেবে ইলম তাঁর প্রহারের কারণে মাদরাসা পড়া ছেড়ে দিয়েছে।
সরকারি আইন বা শিশু মনোবিজ্ঞানের আলোকে প্রহার নিষিদ্ধ হলেও কওমি মাদরাসার নূরানি, নাজেরা ও হিফজ বিভাগে দারাবা (প্রহার) এখনও বহাল তবিয়তে চলছে। তারবিয়াহর নানা পদ্ধতি আছে।
নবীজী (সা.) ছিলেন মুআল্লিম-মানবতার শিক্ষক। তিনি কি প্রহারের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন? এর কোনো নজির নেই। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) রচিত ‘‘আর-রাসুল আল-মুআল্লিম ওয়া আসালিবুহু ফিত-তালীম’’ কিতাবটি আমি কয়েকবার পড়েছি, কিন্তু সেখানে প্রহারের কোনো নববী পদ্ধতি পাইনি।
পারিবারিক, অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণে রাগের বশে তালেবে ইলমদের প্রহার করে যারা, তারা আমার কাছে শিক্ষক বলে মনে হন না; বরং মনে হয় মানসিক রোগী। হাসপাতালে মানসিক রোগের বিভাগ আছে—এমন শিক্ষকদের সেখানে পাঠানো যেতে পারে।
যাঁরা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা শিক্ষকতা সম্পর্কিত পড়ালেখা না করে শিক্ষকতা শুরু করেন, তারা সাধারণত তালেবে ইলমদের বেশি প্রহার করেন। বিশেষ করে নূরানি, নাজেরা বা হিফজখানায় বাড়াবাড়ি পর্যায়ের প্রহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা: এক মুদি (মালিক) তাঁর হিফজ বিভাগের এক প্রহারকারী শিক্ষককে একদিন প্রহারের পর বলেছিলেন, ‘‘আপনি কি তালেবে ইলমকে গরু পেয়েছেন? চলে যান, বাড়িতে গিয়ে গরু লালন-পালন করুন!’’ আসলে, তিনি সেই শিক্ষককে বহিষ্কারও করেছিলেন। বহিষ্কৃত শিক্ষক নিজেই আমাকে এই গল্পটি বলেছেন।
কওমি মাদরাসায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো শিক্ষককে পড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। সেই প্রশিক্ষণে প্রহারবিহীন তারবিয়াহর পদ্ধতিও শেখানো উচিত। অনেক তালেবে ইলম প্রহারের কারণে মাদরাসা ছেড়ে দেয়। অনেক শিশু মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের হাতে।
প্রহার, বেত্রাঘাত ও ক্লাসে অকারণে রাগ প্রকাশ থেকে বিরত থাকা সম্ভব কিনা, তা এখন ভাবতে হবে। এই ক্ষেত্রে সনাতনী চিন্তার পুনর্গঠন প্রয়োজন। আমি তারবিয়াহর বিরোধিতা করছি না, কিন্তু অতিরিক্ত প্রহার ও মানসিক নির্যাতনের বিরোধিতা করছি। এটা কেবল শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই সম্ভব। যাঁরা তালেবে ইলমদের বেশি প্রহার করেন, তাঁদের নিজের সন্তানদের জীবনও সাধারণত সুখময় হয় না।
মুহতারিম শিক্ষকবৃন্দ, আপনি যদি অন্যের ছেলেকে নিজের সন্তান হিসেবে মনে করতে পারেন, তাহলে অতিরিক্ত প্রহার করতে আপনার মন চাইবে না। আর যদি শুধু প্রহার দিয়েই নিজ সন্তানকে লালন-পাতল করেন, তাহলে আপনি আদর্শ পিতা হতে পারেননি।
একজন আদর্শ উস্তায পিতার মতোই হন। যাঁরা প্রহার করেন, আমার এই লেখা হয়তো তাঁদের রাগান্বিত করতে পারে। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই—আমিও একজন শিক্ষক।
লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক ও পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট
আইএইচ/

