Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরাসা শিক্ষা

ইতিহাস, বিস্তার ও সামাজিক প্রভাব

Icon

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৯

ইতিহাস, বিস্তার ও সামাজিক প্রভাব

বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে আসছে। মূলত দুই ধরনের মাদরাসা বিদ্যমান- আলিয়া মাদরাসা এবং কওমি মাদরাসা। আলিয়া মাদরাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় এবং আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসা সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত, দাতব্য এবং ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাকে প্রধান্য দেয়।

কওমি মাদরাসার মূল লক্ষ্য হলো ইসলামী শিক্ষা, নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবিক ও ধর্মীয় জীবন গঠনে সহায়তা করা। এটি কেবল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়, বরং মুসলিম সমাজে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উৎপত্তি ও ইতিহাস: কওমি মাদরাসার ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে শুরু হয়। মুসলিম সমাজে শিক্ষার স্বতন্ত্রতা রক্ষা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেওবন্দি শিক্ষাব্যবস্থা কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি সাহিত্য এবং ইসলামী নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।

বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাগুলি ১৯শ শতকের শেষার্ধে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর (১৯৭১) কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমানভাবে প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও নগর এলাকার দরিদ্র মুসলিম পরিবারের সন্তানরা এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।

২০১৮ সালে সরকারের মাধ্যমে ‘দাওরা হাদিস’ স্তরকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার ইতিহাস কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সামাজিক নেতৃত্ব, নৈতিক গঠন এবং মুসলিম সংস্কৃতির ধারক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।

বোর্ড ও প্রশাসনিক কাঠামো : কওমি মাদরাসাগুলি স্বায়ত্তশাসিত এবং বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বৃহত্তম বোর্ড হলো বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, যা শতাধিক মাদরাসার পরীক্ষা ও পাঠ্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড হলো আলহায়াতুল উল্যা লিলজামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ, যা ২০১৮ সালে সরকার স্বীকৃত কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দাওরা হাদিস স্তরের শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর সমমানের ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও আঞ্চলিক ও ছোট বোর্ডগুলি স্থানীয় মাদরাসাগুলির পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা সমন্বয় করে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রায় ১৪,০০০ কওমি মাদরাসা ছিল এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ২২,৭৫,০০০ হয়েছে, এবং ২০২৫ সালে বোর্ড বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩,৪৯,৭৭৬। এই তথ্য প্রমাণ করে, কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে এবং দেশের মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম : কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তরে বিভক্ত। প্রাথমিক স্তরে আরবি বর্ণমালা, কোরআন তেলাওয়াত এবং ইসলামী নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে হাদিস, তাফসীর, ফিকহ এবং আরবি সাহিত্য পড়ানো হয়। উচ্চতর স্তর বা দাওরা হাদিসে শিক্ষার্থীরা হাদিসের মূল গ্রন্থ, ইসলামী আইন এবং আরবি ভাষার গভীর শিক্ষা লাভ করে।

সাম্প্রতিককালে কিছু মাদরাসায় ইংরেজি, গণিত, কম্পিউটার এবং সামাজিক বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, যদিও এটি সীমিত। শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হলো স্বায়ত্তশাসন, শৃঙ্খলাবদ্ধ পাঠ্যক্রম এবং বোর্ডের মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণ।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা : কওমি মাদরাসাগুলো সমাজে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষার সুযোগ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে বিনামূল্যে বা সামান্য খরচে প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীরা ইসলামী জীবনবোধ, সামাজিক দায়িত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করে। এছাড়া মাদরাসাগুলি মুসলিম ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ধারক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে ইমাম, খতিব, ধর্মীয় শিক্ষক বা সমাজসেবক হিসেবে সমাজে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ে ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায়।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব : কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা কেবল ধর্মীয় ও নৈতিক দিকেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানরা বিনামূল্যে শিক্ষার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে নিযুক্ত হয়। গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

নারী শিক্ষার প্রসার : বাংলাদেশে কিছু কওমি মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সেখানে পড়াশোনার মান ও শিক্ষার গভীরতা বৃদ্ধি করা জরুরি। নারীরাও আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় সমন্বিতভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে পারলে এটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর জন্য নয়, সামগ্রিক সমাজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

চ্যালেঞ্জ : কওমি মাদরাসাগুলি আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণ সীমিত, বোর্ডের মান ও নিয়ন্ত্রণে বৈষম্য রয়েছে এবং দানভিত্তিক অর্থায়নের কারণে অবকাঠামোর অভাব দেখা দেয়। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সীমিত এবং নারীর শিক্ষার সুযোগ এখনও অনেক ক্ষেত্রে সীমিত। এছাড়া  গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে সংযোগ কম, যা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা সংযোজনে বাধা সৃষ্টি করে।

সমাধান ও সুপারিশ : কওমি মাদরাসার উন্নয়নের জন্য আধুনিক শিক্ষার সংযোজন, বোর্ড সমন্বয়, সরকারি ও সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি, অর্থায়নের বৈচিত্র্য এবং শিক্ষার্থীর বিকল্প কর্মক্ষেত্র ও উচ্চশিক্ষার সংযোগ নিশ্চিত করা উচিত। নারীর শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং আলাদা নারী কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন অত্যন্ত জরুরি। গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা যদি আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, শিক্ষার্থীরা সমন্বিত শিক্ষা লাভ করবে, ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এবং দরিদ্র পরিবার ও গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং ধর্মীয় ও নৈতিক দিকের সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাস প্রমাণ করে, কওমি মাদরাসার উদ্ভব ও বিস্তার মুসলিম সমাজে শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য ও সংস্কৃতির ধারাকে ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। বোর্ড কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনের মাধ্যমে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষাপথ নিশ্চিত করে।

শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত কোরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসীর এবং আরবি ভাষার গভীর শিক্ষা প্রদান করে। সাম্প্রতিককালে আধুনিক বিষয় যেমন ইংরেজি, গণিত, কম্পিউটার ও সামাজিক বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সমন্বিত ও বাস্তবমুখী শিক্ষা পায়। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

আধুনিক শিক্ষার সংযোজন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং নারীর শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আরও প্রাসঙ্গিক, সমন্বিত এবং কার্যকর শিক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এটি শুধুমাত্র শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও নৈতিক নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের সক্ষম করে তুলবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার অনুরাগী

আইএইচ/

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর