Logo

শিক্ষা

শিক্ষার্থীদের ভাবনা

কওমি মাদরাসায় সাহিত্যচর্চা

Icon

নাঈমুল হাসান তানযীম

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:০৩

কওমি মাদরাসায় সাহিত্যচর্চা

কওমি মাদরাসায় কি বাংলাচর্চা হয়? বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাদের আগ্রহ কেমন? জাতীয় দৈনিকে তারা কতটুকু সরব? মাদরাসাগুলোতে কি বাংলা চর্চার অবাধ সুযোগ রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন মাদরাসার কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার শিক্ষার্থী- নাঈমুল হাসান তানযীম 

কওমি  মাদরাসায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ব্যাপকায়ন জরুরি 

দেলাওয়ার আদনান

শিক্ষার্থী : আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কায়রো, মিশর

আমাদের দেশে প্রধানত দু’ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এনসিটিবির আওতাধীন সরকারি বিদ্যালয় এবং দরসে নেজামির আওতাভুক্ত কওমি  মাদরাসা। সংক্ষেপে বললে, উপমহাদেশে বৃটিশদের দখলদারত্বের বহুকাল আগে থেকেই দরসে নেজামি চালু ছিল। এবং তৎকালীন দরসে নেজামিতে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপস্থিতিও ছিল সমান্তরালভাবে। 

পরবর্তীকালে বৃটিশরা ভারতবর্ষে তাদের উপনিবেশবাদকে শক্তপোক্ত করতে, মুসলিমদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে শতধা বিভক্ত করার জন্য দরসে নেজামিকে সমূলে ধ্বংস করে, সম্পূর্ণ ওয়েস্টার্ন পদ্ধতিতে হালজমানার এনসিটিবির শিক্ষাসিলেবাস প্রণয়ন করে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং তাঁদের মধ্যে নূন্যতম ইসলামি জ্ঞান জিইয়ে রাখতে তৎক্ষণাৎ যেই সিলেবাস তৈরি করা হয়েছিল, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই পরাজিত দেশের সিলেবাসকেন্দ্রিকই পড়ানো হচ্ছে কওমি  মাদরাসাগুলোতে। যে কারণেই একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত এদেশের  মাদরাসাগুলোতে বাঙলাভাষা অচর্চিতই রয়ে গেছে। এরপর ১৯৮৪ সালে বিশ্ববিখ্যাত আলেম আলী নদভী রহ. বাংলাদেশ সফরে এসে আলেমদের বাঙলাভাষা চর্চার ব্যাপারে পরামর্শ প্রদানের পর থেকে কিছু  মাদরাসায় ব্যক্তিপর্যায়ে সাহিত্য চর্চা আরম্ভ হয়। এবং পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকে। তবে এতোদিনে  মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যের যেই নবজাগরণ ঘটার কথা ছিল- মাদরাসাগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্য চর্চার অবাধ সুযোগ না থাকায় তা হচ্ছে না।

আদরে থাকুক বাংলা অক্ষর

খালিদ সাইফুল্লাহ 

শিক্ষার্থী : জামিয়াতুল উস্তাদ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী (রহ.) মোহাম্মদপুর, ঢাকা 

যাদের মাতৃভাষা বাঙলা, বাঙলা শিখতে লিখতে, বাঙলা চর্চায়, তারা পিছিয়ে থাকবে এটা অযৌক্তিক। হ্যা, মূর্খ হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সমাজে যিনি মান্যবর, আলেম তিনি নিজের ভাষায় তাঁর জ্ঞানের দ্যূতি ছড়িয়ে দিতে অক্ষম, তার দীর্ঘ জীবনের অর্জিত কুরআন হাদিসের জ্ঞান জাতির কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না, ব্যাপারটা লজ্জাজনক। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, আমাদের এই লজ্জার ইতিহাস দীর্ঘ। কওমি  মাদরাসায় বাঙলা পড়ানো হবে না। হাদিস কুরআনের ব্যাখ্যা, অনুবাদ হবে উর্দু ভাষায় এই চিন্তায় ডুবে ছিলাম আমরা বহুকাল। কওমির চৌকাঠে বাঙলার প্রবেশ ছিলো নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রজন্মের কাণ্ডারী হয়ে যারা আসেন তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন না। সময়ের চোখে তাঁরা দেখেন হাজার বছর দূরের ভবিষ্যৎ। শাহ আতহার আলী (রহ.) সব বিতর্ক উপেক্ষা করে, কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিতে বাঙলা চর্চা শুরু করেন। শামছুল হক ফরীদপুরী (রহ.) বাঙলাভাষাকে বেছে নেন দ্বীন প্রচারের মাধ্যম হিসেবে। অসংখ্য গ্রন্ত রচনা করে পরবর্তীদের জন্য রেখে যান সঠিক পথনির্দেশ। তিনি তখনই স্বপ্ন দেখতেন বাঙলাভাষায় আমাদের একটি দৈনিক হবে। যে স্বপ্ন আজও অধরা। বাঙলা চর্চায় কওমির প্রতিকূল পরিবেশ থেকে উঠে আসেন ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, ড.মুশতাক, ইসহাক ফরিদী (রহ.) আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া (রহ.)

আমাদের দরদী মালী আবু তাহের মিসবাহ (আদীব হুজুর)। তাঁদের ছায়ায় জন্ম নেন সমকালের তরুণদের আইডল যাইনুল আবিদীন, শরীফ মুহাম্মাদ, ইয়াইয়াহ ইউসুফ নদভী। যাদের দেখে কওমি তরুণেরা সাহস খুঁজে পাচ্ছে। এখন শুধু সাহিত্য চর্চা দেওয়াল পত্রিকায় সীমাবদ্ধ নয়। তরুণদের হাতে প্রকাশিত হচ্ছে সাহিত্যে উন্নিত মাসিক, দ্বিমাসিক পত্রিকা। জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে আমাদের গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার। বাঙলা সাহিত্যে অনেক কিছু করে ফেলেছি এই দাবি করছি না। তবে স্বপ্নবাজ এই কওমী তরুণেরা যদি যোগ্য গাইডলাইন পায়, সাহিত্যচর্চার পরিবেশ আরেকটু অনুকূল হয় এদের মাধ্যমেই একটি জাগরণ সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

কওমি  মাদরাসায় সাহিত্য চর্চার বর্তমান রূপ

সাইফুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম

শিক্ষার্থী : মাদরাসা কাসিমিয়্যাহ, ময়মনসিংহ

আলহামদুলিল্লাহ, কওমি  মাদরাসাগুলোতে বর্তমানে একদম শুরুর ক্লাস তথা ‘নুরানি’ থেকেই শিশুদের আরবির পাশাপাশি বাংলা শেখানো হচ্ছে। বাঙলা সাহিত্য নিয়ে এখনকার কওমি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ-উদ্দীপনাও উল্লেখযোগ্য। কিতাব বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত বাঙলা সাহিত্য চর্চায় হাত বাড়াচ্ছেন অনেকেই। অধুনা কওমি  মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে বাঙলা সাহিত্য চর্চার প্রতি বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  মাদরাসার দেওয়ালিকা, ভাঁজপত্র, মাসিক- ত্রৈমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও তাদের সরব উপস্থিতি। 

একসময় এসব কওমি  মাদরাসায় বাঙলা চর্চার অবাধ সুযোগ না থাকলেও বর্তমানে অনেকাংশেই শিথিলতা পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো  মাদরাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বাঙলা সাহিত্য চর্চায় উদ্ভুদ্ধ করতে বাৎসরিক বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করছেন। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করছেন। লেখালেখি, সাহিত্য চর্চা ও বিকাশে এসব  মাদরাসা থেকে নিয়মিত দেওয়ালিকা বের হচ্ছে। বাংলা সাহিত্য চর্চার এই বিষয়টি এই অঙ্গনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে সুফলই বয়ে আসবে বলে আমি আশাবাদী। মাতৃভাষায় দক্ষতা ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে আমি মনে করি। এতে করে ইসলামকে স্বজাতির কাছে সহজ, সুন্দর, সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা যাবে। 

কওমি  মাদরাসায় বাংলা সাহিত্যের জোয়ার এসেছে

আমীরুল ইসলাম ফুআদ 

শিক্ষার্থী : জামিয়াতু ইবরাহীম সাইনবোর্ড, ঢাকা

একটা সময় কওমি  মাদরাসায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা একদম ছিল না বললেই চলে। যারা এই অঙ্গনে থেকে বাঙলা চর্চা করতো; তাদেরকে দেখা হতো অন্য দৃষ্টিতে। কখনও আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করা হতো। কিন্তু, ধীরে ধীরে সে সংকটময় সময় কেটে গেছে। আগের মতো কওমি  মাদরাসায় এখন বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবহেলাবোধ করে না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ করা হয় বাংলা চর্চা করতে। অদম্য আগ্রহ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরাও বুকে সাহস পায়। স্বপ্ন আঁকে হৃদয়ে। নিরবচ্ছিন্নভাবে চর্চা করতে থাকে বাঙলা সাহিত্য। যখন তাদের লেখার হাত কিছুটা পাকাপোক্ত হয় তখন তারা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকে। ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখে আনন্দে চোখেমুখে উচ্ছাসের ঢেউ খেলে যায়। তারপর আরও এক ধাপ এগিয়ে দৈনিক পত্রিকায় সরব হতে থাকে। দিনদিন তারা এগিয়েই যাচ্ছে। প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন অবশ্যই তারা বাঙলা সাহিত্যে নেতৃত্ব দেবে-এই প্রত্যাশা রাখি।

আইএইচ/

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর