Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরাসায় ছাত্র বৃদ্ধি

আলোকিত ভবিষ্যতের হাতছানি

Icon

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১১

আলোকিত ভবিষ্যতের হাতছানি

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রসংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। অপরদিকে কওমি মাদরাসায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটি নিছক কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়, বরং সামাজিক মূল্যবোধ, অভিভাবকদের ধর্মীয় চেতনা এবং মাদরাসাশিক্ষার গুণগত পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলন। লেখাপড়ার পাশাপাশি বর্তমান সময়ের কওমি মাদরাসাগুলো মানবিক গুণাবলি, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও আদর্শ মানুষ গঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

উস্তাদদের দায়িত্বশীলতা ও আত্মবিসর্জন

কওমি মাদরাসার ছাত্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো উস্তাদদের অগাধ দায়িত্বশীলতা ও আত্মবিসর্জন। পার্থিব চাহিদা, ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে তাঁরা সীমিত জীবিকা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আজীবন নিবেদিত থাকেন। দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে‌ অপরিমেয় ধৈর্য ও নিষ্ঠা নিয়ে তারা মাদরাসার প্রতিটি মুহূর্ত শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করেন। মানুষ নিজের সন্তানদের প্রতি যেমন দায়িত্বশীল থাকে, মাদরাসার উস্তাদগণও তেমনি প্রতিজন ছাত্রকে বাবার দয়া, পরিবারের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কেবল পাঠদানে না, ছাত্রদের চরিত্র গঠন, আমল-আখলাকের সংশোধনে তারা আজীবন নিবেদিত থাকেন।

পাঠ্যক্রমে বৈচিত্র্য

বর্তমান সময়ের কওমি মাদরাসাগুলো আর পূর্বের মতো কেবল ধর্মীয় পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়। কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি ভাষার পাশাপাশি এখন এসব মাদরাসায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো জাগতিক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণামূলক শিক্ষা চালু করেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা আলেম হওয়ার পাশাপাশি পার্থিব বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজেও অংশ নিতে পারছে। একজন আলেম ব্যবসায়ী হবেন, আজ থেকে বিশ বছর আগে এটা কল্পনা করাও ছিল দুষ্কর। আর এখনকার আলেমরা ব্যাপকভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। নিজেদের মেধা বুদ্ধি খাটিয়ে কেউ কেউ হয়ে উঠছেন সফল উদ্যোক্তাও। 

নীতিনৈতিকতা ও চরিত্রগঠন

বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, মাদক, পর্নোগ্রাফি ও অসভ্যতার যে স্রোত বইছে, সেখানে কওমি মাদরাসা শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখানে ছাত্রদের জীবনযাপন পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, আত্মউন্নয়ন, ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সচ্চরিত্র প্রভৃতির বাস্তব অনুশীলনেই কাটে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত।

এই ধারাবাহিক নিয়মশৃঙ্খলা ছাত্রদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য ও আত্মসম্মানের গুণে গুণান্বিত করে। বর্তমান সমাজে যখন ‘চরিত্রবান মানুষ’ দুর্লভ সম্পদে পরিণত হয়েছে, তখন কওমি মাদরাসা হয়ে উঠেছে সেই চরিত্রবান মানুষ গড়ার কারখানা। ফলে অভিভাবকরা বুঝতে পারছেন, সন্তানকে এখানে পাঠালে দুনিয়াবি উপকারের পাশাপাশি আখিরাতেরও মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব

কওমি মাদরাসার আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব। ছোট-বড় ছাত্রদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের পিতৃসুলভ আচরণ আর উস্তাদদের প্রতি ছাত্রদের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কওমি মাদরাসার শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ। এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহ অন্য কোথাও খুব কমই দেখা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মুসলমানদের হৃদয়ঙ্গম সম্পৃক্ততা ও অবিচ্ছিন্ন সহযোগিতা। ফলে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা আজ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও আত্মিক জীবনের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

একসময় অনেকের ধারণা ছিল, কওমি মাদরাসায় পড়লে দুনিয়াবি জীবন গড়ে তোলা কঠিন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই ধারণা বদলে গেছে। কওমি ধারায় শিক্ষা গ্রহণের পর এখন বহু শিক্ষার্থী জাগতিক উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে; কেউ কেউ হয়ে উঠছে ইসলামি গবেষক, লেখক, সাংবাদিক বা প্রভাবশালী বক্তা।

ফলে অভিভাবকদের মনেও কওমি শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা দিন দিন বাড়ছে। এখন অনেক পরিবার স্বেচ্ছায় সন্তানদের কওমি মাদরাসায় ভর্তি করছে। শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরাঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য হারে কওমি মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সামাজিক ভূমিকা

দেহ ও আত্মার সমন্বয়েই মানুষ। দেহের জন্য যেমন খাদ্য অপরিহার্য, তেমনি আত্মার পুষ্টির জন্য প্রয়োজন আল্লাহভীতি, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধি। ধর্মীয় শিক্ষা সেই আত্মিক তৃপ্তির উৎস, যা মানুষকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করে এবং জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে। আজ বিশ্বব্যাপী যে নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক অস্থিরতা ও সামাজিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার একমাত্র প্রতিষেধক হলো আল্লাহমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। কওমি মাদ্রাসাগুলো সেই আদর্শিক শিক্ষাই দিচ্ছে, যা মানুষকে আল্লাহনির্ভর ও নৈতিকভাবে দৃঢ় করে গড়ে তুলছে। বর্তমানে কওমি মাদরাসার আলেমগণ দেশের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। কেউ শিক্ষকতা করছেন, কেউ সমাজসেবা, সাংবাদিকতা, ইসলামি গবেষণা বা দাওয়াতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজকে আলোর দিশা দিচ্ছেন। বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইসলাম প্রচারে কওমি শিক্ষিত তরুণদের ভূমিকা অনন্য। তাঁরা সুন্দর ভাষায়, যুক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে ইসলামি বার্তা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন। এর ফলে কওমি শিক্ষার ভাবমূর্তি ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রয়োজন যথাযথ কর্মপরিকল্পনা

কওমি মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির এই ইতিবাচক ধারা যেমন আমাদের জন্য আনন্দের, তেমনি এটি এক বিশাল দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জও বটে। এসব শিক্ষার্থী আগামী দিনের আদর্শিক, নৈতিক ও আলোকিত সমাজ গঠনের হাতিয়ার। তাই এই বিপুল মানবসম্পদকে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক। এ প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত কর্মপরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

১. দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ : কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার, ভাষা, গণমাধ্যম, অনুবাদ, গবেষণা ও সমাজসেবা-সংক্রান্ত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে তারা দাওয়াতি কাজের পাশাপাশি পেশাগত ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

২. আধুনিক প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষা : ইসলামি জ্ঞানের প্রয়োগভিত্তিক শাখা যেমন ইসলামি অর্থনীতি, ব্যাংকিং, শরিয়াহভিত্তিক গবেষণা, নৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদিতে কওমি ফারেগিনদের যুক্ত করা প্রয়োজন। এতে তারা শুধু মসজিদ-মাদরাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজসেবার মতো বিভিন্ন সেক্টরে নৈতিক আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারবে।

৩. রাষ্ট্র ও সমাজের সহযোগিতা : রাষ্ট্র ও সমাজকে এই মেধাবী ছাত্রদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সহযোগিতা ও স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়ানো সম্ভব। কওমি শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখেও যদি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো যায়, তবে এই শিক্ষার্থীরাই হতে পারে ভবিষ্যতের সফলতার কাণ্ডারি। তাঁদের হাত ধরেই গড়ে উঠতে পারে আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।

কওমি মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি নবজাগরণের এক আশাব্যঞ্জক সঙ্কেত। যে জাতি ধর্মীয় ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, সেই জাতিই আলোকিত ও টেকসই সমাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে পারে। কওমি মাদরাসার এই ছাত্রবৃদ্ধি সেই সম্ভাবনার এক ভবিতব্য প্রতীক। কওমিয়ানদের মুরব্বি ও দায়িত্বশীল আলেমগণ যদি সঠিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারেন, তাহলে এখানে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরাই হবে আগামী দিনের ইমাম, শিক্ষক, নীতিবান নেতা, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও সমাজসংস্কারক। ইনশাআল্লাহ তাঁদের হাতেই জাগ্রত হবে মানবতার প্রকৃত চিত্র।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর