শিক্ষাব্যবস্থা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বরং তা সমাজের চলমান হৃদস্পন্দন। বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা, তা কেবল কিতাবের পাতায় নয়, আমাদের অস্তিত্বের গভীরে প্রোথিত।
উপমহাদেশের ইতিহাসের এক চরম সন্ধিক্ষণ। ব্রিটিশের আগ্রাসন মুসলিম সমাজের শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যকেও বিপন্ন করে তুলেছিল। ঠিক তখনই, ১৮৬৬ সালে উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দে এক নীরব ও দৃঢ় সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। যে শিক্ষালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল, তা ছিল টিকে থাকার এক অকুণ্ঠ অঙ্গীকার, এক গভীর প্রত্যয়। দারুল উলুম দেওবন্দের সেই মডেল অনুসরণ করে গড়ে ওঠা ‘কওমি মাদ্রাসা’ (জাতীয় মাদরাসা) জনগণের ত্যাগের অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল তারা। এটি কেবল ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটি মুসলমান পরিচয়ের অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করেছে।
শেকড়ের শক্তি : অবদান ও নেতৃত্ব
যেখানে আবেগ জড়িয়ে আছে; আমাদের ইতিহাসের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান ভুলে যাওয়া অসম্ভব। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান, বিশেষত হাদিস ও ফিকহের প্রথাগত শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখা তাদের মৌলিক সাফল্য এবং আমাদের জন্য এক বড় স্বস্তি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই ধারার আলেমদের প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা ছিল। ফতোয়া এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা ছিল। এটি আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়, যা বারবার আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। তৃণমূল পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তারা সমাজের একটি বিশাল অংশের ওপর আজও অবিচ্ছিন্ন প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
কিন্তু ইতিহাসের সেই গৌরবময় অধ্যায় আর আজকের বাস্তবতার মাঝে বিস্তর ফারাক। একবিংশ শতাব্দীর দরজা উন্মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো এক গভীর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্নটা আজ বড়ই তীব্র: এই শিক্ষাধারা কি শুধু আধ্যাত্মিক মুক্তি দেবে? নাকি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিও এনে দেবে? কারণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছাড়া কোনো অস্তিত্বকেই দীর্ঘমেয়াদে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, এটি একটি কঠিন বাস্তবতা।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা : মর্যাদা রক্ষার আহ্বান
কওমি মাদ্রাসার ভবিষ্যৎকে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের সাথে যুক্ত করার একটি সম্ভাব্য পথ হলো, তাকে সরকারি কাঠামোর অধীনে এনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। তারা তাদের স্বকীয়তাকে ভালোবাসেন। তাই সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আজ অনস্বীকার্য।
১) শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা : শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড। একজন মুহাদ্দিস, যিনি বছরের পর বছর ধরে জ্ঞান বিতরণ করছেন, ফিকহ-এর জটিলতা সহজ করে দিচ্ছেন। তিনি সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। ফলে সরকার থেকে একটি সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) এবং পেনশনের নিশ্চয়তা হতে পারে।
২) শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধি : বৈষম্যের অবসান: সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো কওমি শিক্ষার্থীরাও উপবৃত্তির আওতায় আনা যেতে পারে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই এবং উন্নত চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে।এগুলো তাদের মৌলিক অধিকার। সরকারি নিয়ন্ত্রণে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হবে। আধুনিক গবেষণাগার এবং উন্নত পাঠাগার তৈরি করা সম্ভব হবে। এটি তাদের শিক্ষার মানকে উন্নত করতে অপরিহার্য। বৈষম্য দূর করে সবাইকে একই ছাতার নিচে আনা হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
৩) সনদের পূর্ণাঙ্গ গ্রহণযোগ্যতা : মূল স্রোতে যুক্ত হওয়ার পথ: সরকারের অধীনে এলে দাওরায়ে হাদিসের সমমান স্বীকৃতির বিষয়টি কেবল কাগজে-কলমে নয়, স্থায়ী ও সর্বজনীন হয়ে উঠবে। একইসাথে, নি¤œস্তরের সনদগুলোও জাতীয় শিক্ষাক্রমের সাথে সমন্বিত হয়ে একটি সুস্পষ্ট মানদণ্ড লাভ করবে। ফলে কওমি শিক্ষিত যুবকরা সামরিক-বেসামরিক উভয় প্রকার কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। তারা দেশের মূল অর্থনৈতিক স্রোতে যুক্ত হতে পারবে, যা সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আধুনিকায়নের অপরিহার্যতা :
শেকড় ধরে আধুনিকতার ছোঁয়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত হলেও, অভ্যন্তরীণ আধুনিকায়ন অত্যাবশ্যক। আধুনিকায়ন মানে ঐতিহ্যকে গলা টিপে হত্যা করা নয়। বরং তাকে সময়ের উপযুক্ত পোশাকে সাজিয়ে তোলা:
১) শিক্ষাক্রমের সমন্বয় : আপস-অযোগ্য পবিত্রতা। মাদ্রাসার মূল ধর্মীয় শিক্ষাকে অপরিবর্তিত রেখে, এই শেকড়কে একবিন্দুও নড়ানো যাবে না, এটাই আপস-অযোগ্য। কিন্তু একইসাথে, আবশ্যিক আধুনিক বিষয়গুলো (গণিত, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি ও তথ্যপ্রযুক্তি) গুণগত মান বজায় রেখে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই শিক্ষাই তাদের বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে। অবশ্য বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই এই কার্যক্রম বিদ্যমান।
২) ডিজিটাল ও প্রশাসনিক বিপ্লব : মাদ্রাসার অভ্যন্তরে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়। ভর্তি, ফলাফল তৈরি, হিসাবরক্ষণ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হাজিরা সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনা যেতে পারে। এটি কেবল কাজের গতি ও নির্ভুলতাই বাড়াবে না। বরং স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করবে, যা সময়ের দাবি।
একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপের আহ্বান :
কওমি মাদরাসার মুরুব্বি এবং সরকারের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ ও আন্তরিক সংলাপ স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। মাদরাসার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। যদি এটিকে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে এটি একদিকে যেমন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবে, তেমনই অন্যদিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধা বহুগুণ বৃদ্ধি করবে। এটি কেবল মাদ্রাসাগুলোর উন্নতি নয়। বরং দেশের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে মূলধারার উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করার মাধ্যমে জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক- নান্দাইল, ময়মনসিংহ

