কওমি মাদ্রাসা শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি হৃদয় গঠনকারী ত্বরীকাহ (পথ), যেখানে জ্ঞানের পাশাপাশি চরিত্র, আদব, ও বিনয় শেখানো হয়। এখানকার প্রতিটি ইট, প্রতিটি ক্লাসরুম, এমনকি প্রতিটি পৃষ্ঠা একটি আদবের বার্তা বহন করে। এই মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্রদের শেখানো হয় ওস্তাদ শুধুমাত্র শিক্ষক নন, বরং জ্ঞানের দরজা খুলে দেওয়া একজন পথপ্রদর্শক। তাই ওস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি শুধু বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ইমানি চেতনারই অংশ।
ওস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা :
ইসলামে আদব বা শিষ্টাচারের স্থান অত্যন্ত উচ্চ। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সূরা হুজরতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের কণ্ঠ নবীর কণ্ঠের উপর উঁচু করো না এবং তাঁর সামনে উচ্চস্বরে কথা বলো না।’ এই আয়াত আমাদের শিখিয়ে দেয়- আদব কেবল নবীর প্রতি নয়, বরং জ্ঞান ও দ্বীন বহনকারীদের প্রতিও প্রযোজ্য। হযরত আলী (রাযি.) বলেছেন, ‘যে আমাকে একটি অক্ষরও শিক্ষা দিয়েছে, আমি তার দাস হতে রাজি।’ এ কথাটিই কওমি ছাত্রদের হৃদয়ে জীবন্ত হয়ে থাকে। তারা জানে, ওস্তাদ তাদের দ্বীনি জীবনের পথপ্রদর্শক। তাঁর পায়ের ধুলোতেই বারাকাহ। তাঁর দোয়া ও সন্তুষ্টিতেই সফলতার নিশ্চয়তা।
জুতা বহন ভালোবাসার সূক্ষ্ম প্রকাশ :
অনেক সময় দেখা যায়, কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা ওস্তাদের জুতা হাতে তুলে নেয়, দরজার কাছে এগিয়ে দেয়, কিংবা ওস্তাদ আসার সময় সম্মান দেখিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বাইরে থেকে যারা এই দৃশ্য দেখে, তারা হয়তো এটিকে অতি বিনয় বা ‘অপ্রয়োজনীয়’ আনুগত্য মনে করতে পারে। কিন্তু আসলে এটি তাদের হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণের নিদর্শন।
ওস্তাদের জুতা বহন করা কোনো “বাধ্যবাধকতা” নয়। বরং একটি ভালোবাসার প্রতিক্রিয়া। এটি ছাত্রের অন্তরের এক নিঃশব্দ ভাষা।
হে আমার ওস্তাদ, আপনি আমাকে আল্লাহর পথে হাঁটতে শিখিয়েছেন, তাই আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার জন্য সম্মানের।
ওস্তাদের দোয়া ছাত্রের জীবনের মূলধন :
ওস্তাদও এসব দেখে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে দোয়া করেন। অনেক সময় তাঁরা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে কুরআনের খেদমতের যোগ্য বানান, তোমার আমল কবুল করুন।’ একটি আন্তরিক দোয়া ছাত্রের জীবনের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে। সেই দোয়া হয়তো একদিন তাকে আলেম, দাঈ, কিংবা একজন সত্যিকারের মুমিন বানিয়ে দেয়।
কওমি ধারায় একটি গভীর বিশ্বাস আছে
ওস্তাদের সন্তুষ্টি মানে আল্লাহর সন্তুষ্টি, আর ওস্তাদের অসন্তুষ্টি মানে বরকতের অভাব।
তাই ছাত্ররা ওস্তাদের প্রতিটি নির্দেশে বিনয় ও আদব বজায় রাখে।
সম্মানের সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে :
বর্তমান প্রজন্মে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলো এখনো সেই পুরনো দীপ্তি ধরে রেখেছে। এখানে ছাত্ররা জানে ওস্তাদের সামনে বসার ধরনও একধরনের ইবাদত। ওস্তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তার সামনে পা না ছড়ানো, চোখ নিচু রাখা এসবই তাদের শেখানো হয় ‘আদবের পাঠে’।
যে ছাত্র ওস্তাদের সামনে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার অন্তরে জ্ঞানের আলো ঢেলে দেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেছিলেন, ‘আমি যখন আমার ওস্তাদ মালিক ইবন আনাসের সামনে বসতাম, আমি তাঁর সামনে পাতার মতো নড়তাম না।’ এই শিক্ষাই কওমি ছাত্রদের আত্মায় জীবন্ত।
সম্মানের বদলে অহংকার নয়; জুতা বহন করার মতো ক্ষুদ্র একটি কাজও বড় শিক্ষা দেয়। এটি শেখায়, আল্লাহর পথে চলতে হলে অহংকার ভাঙতে হয়, হৃদয়কে নরম করতে হয়। যে মানুষ ওস্তাদের জুতা বহন করতে লজ্জা পায়, সে আসলে বিনয়ের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত।
কওমি মাদ্রাসার এই আদব, এই ভালোবাসা, এই বিনয়এগুলোই আমাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তি। ওস্তাদের প্রতি সম্মান শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা নয়; এটি ইমানের সৌন্দর্য, দ্বীনের মর্ম। ওস্তাদের জুতা বহন করা ছাত্রের দাসত্ব নয়, বরং তাঁর হৃদয়ের আনুগত্য। এ সংস্কৃতিই আমাদের মনে করিয়ে দেয়- জ্ঞান তখনই আলো হয়ে ওঠে, যখন তা বিনয়ের প্রদীপে জ্বলে।
লেখক: আলেম, শিক্ষক, লেখক-প্রাবন্ধিক

