দেওবন্দ থেকে আজকের কওমি মাদরাসা : পরিবর্তনের পথ নাকি বিচ্যুতির আশঙ্কা
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৩
একসময় কওমি মাদরাসা মানেই ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র, তাকওয়ার প্রশিক্ষণশালা, বিনয় ও ত্যাগের প্রতিষ্ঠান। সেখানে আলেম হতেন এমন মানুষ, যিনি শুধু হাদিস জানেন না- বরং সেই হাদিস নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু আজ প্রশ্ন উঠছে- আমরা কি সত্যিই সেই চেতনা ধরে রাখতে পেরেছি? আজকের কওমি মাদরাসাগুলো কি এখনো দেওবন্দের মূল আদর্শে চলছে, নাকি কেবল নামমাত্র ঐতিহ্য বহন করছে?
দেওবন্দ এক চেতনার নাম
১৮৬৬ সাল। ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনের ভারে ক্লান্ত, মুসলমানরা হতাশ ও পরাজিত। সে সময় কয়েকজন আলেম, ত্যাগী ও দূরদর্শী মানুষ সাহসী এক উদ্যোগ নেন- তারা প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। এই প্রতিষ্ঠান কেবল একটি মাদরাসা ছিল না; এটি ছিল এক আন্দোলন- ইসলামী জ্ঞান, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির পুনর্জাগরণ আন্দোলন।
দেওবন্দের শিক্ষার মূল দর্শন ছিল
* আল্লাহভীরুতা ও বিনয় * সরল জীবন ও ত্যাগ * কুরআন-সুন্নাহর আলোয় সমাজে নেতৃত্ব এবং “আমল” ও “ইলম”-এর মেলবন্ধন।
কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা প্রদান। যা ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করে এবং জীবনকে ইসলামী মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার্থীদেরকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করা। কুরআন-সুন্নাহর উপর কঠোরভাবে নির্ভরশীল এবং দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী আইনকে অনুসরণ করার ওপর জোর দেওয়া। সুতরাং দেওবন্দের কাম্য- এমন মানুষ তৈরি করা, যারা হবে জ্ঞানের সঙ্গে চরিত্রবান, বিনয়ী ও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত।
কওমি ধারার বিস্তার
দেওবন্দের আলো দ্রুত ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে কওমি মাদরাসা- যেখানে আলেমরা বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন, ছাত্ররা রাত্রে কেরোসিন বাতির নিচে বসে কিতাব পড়তেন। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই- “দীনের খেদমত”। এই ধারাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইসলামী সমাজের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে। কওমি মাদরাসা থেকে হাজার হাজার আলেম, ইমাম, খতিব, শিক্ষক ও সমাজসেবক তৈরি হয়- যারা ইসলামী সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি অন্যরকম। এখন দেখা যায়, মাদরাসা আছে, ছাত্র আছে, ভবন আছে, বাজেটও আছে- কিন্তু সেই “আত্মা”, সেই “রুহ”, সেই “চেতনা” যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। অনেক মাদরাসায় এখন লক্ষ্য থাকে কতজন ছাত্র ভর্তি হলো, কত দান এল, কত বিল্ডিং হলো- কিন্তু কতজন মানসিকভাবে শুদ্ধ, বিনয়ী, সমাজসচেতন আলেম তৈরি হলো- সে হিসাব কেউ রাখে না। দেওবন্দের আলেমরা ছিলেন খেদমতের মানুষ, আজ আমরা হয়ে গেছি প্রদর্শনের মানুষ। এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
কোথায় হারালাম আমরা
১. উদ্দেশ্য বদলে গেছে : একসময় মাদরাসার লক্ষ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দীনের প্রচার। আজ অনেক জায়গায় তা হয়ে গেছে ব্যক্তিগত প্রভাব, প্রতিযোগিতা, বা আর্থিক স্বার্থের ক্ষেত্র।
যে শিক্ষক একসময় আল্লাহর জন্য পড়াতেন, আজ তাকেও অনেকে চাকরি মনে করেন।
ফলাফল- পড়াশোনায় বারাকাহ হারিয়ে যাচ্ছে।
২. মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, চিন্তাশক্তিহীন ছাত্র : দেওবন্দের ছাত্ররা বই মুখস্থ করতেন না, বই বুঝতেন। তারা চিন্তা করতেন, প্রশ্ন করতেন, নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতেন। আজ অধিকাংশ জায়গায় কিতাব পড়ানো হয় যেন শুধু সনদ পাওয়ার জন্য। ছাত্ররা পাস করছে, কিন্তু আলেম হিসেবে সমাজে দিকনির্দেশ দিতে পারছে না।
৩. নেতৃত্বের সংকট : আগের যুগে মাদরাসার প্রধান হতেন আলেম ও আখলাকে অগ্রগণ্য মানুষ।
এখন অনেক জায়গায় নেতৃত্ব নির্ভর করছে প্রভাব, আত্মীয়তা বা অর্থের ওপর। ফলে যোগ্য কিন্তু বিনয়ী শিক্ষকরা পিছিয়ে যাচ্ছেন।
এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে দেওবন্দের নেতৃত্বের মহিমা।
৪. দলাদলি ও বিভাজন : একসময় সব কওমি মাদরাসা এক পরিবার ছিল। আজ বোর্ডে বোর্ডে বিভক্ত- কেউ বেফাক, কেউ হাইআতুল উলয়া, কেউ স্বাধীন। একজন আরেকজনকে স্বীকৃতি দেয় না। দেওবন্দের ঐক্যের চেতনা এখন পরিণত হয়েছে বিভক্তির প্রদর্শনীতে।
৫. সমাজ থেকে দূরে সরে যাওয়া : দেওবন্দের আলেমরা সমাজের প্রতিটি স্তরে কাজ করতেন- শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, দাওয়াত- সর্বত্র। আজ অনেক মাদরাসা নিজেদের চারদেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমাজের মানুষ, তরুণ প্রজন্ম বা মিডিয়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ফলে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা সমাজে পৌঁছায় না।
ফলাফল
এই বিচ্যুতির কারণে কওমি শিক্ষা আজ এক ধরনের সংকটে পড়েছে। একদিকে রয়েছে সনদের স্বীকৃতি, অন্যদিকে হারিয়েছে সামাজিক প্রভাব ও আস্থা। আজ সাধারণ মানুষ আলেমকে শ্রদ্ধা করে ঠিকই, কিন্তু অনেক সময় অনুসরণ করে না। কারণ, আখলাক ও চরিত্রে দূরত্ব বেড়েছে। যেখানে দেওবন্দ চেয়েছিল “আলেমে দ্বীন” তৈরি করতে, সেখানে এখন “ডিগ্রিধারী বক্তা” তৈরি হচ্ছে।
দেওবন্দের পথে ফিরে যাওয়া
আমাদের এখন প্রয়োজন নতুন বিল্ডিং নয়, নতুন চেতনা। প্রয়োজন এমন শিক্ষা যা মাথায় নয়, হৃদয়ে ঢোকে। দেওবন্দের পথে ফিরতে হলে-
১. শিক্ষা নয়, চরিত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে : শিক্ষক ও ছাত্র- উভয়ের মধ্যে তাকওয়া, বিনয়, আখলাক ও আমলকে সর্বাগ্রে রাখতে হবে।
২.পাঠ্যক্রমে চিন্তাশক্তি গড়ে তুলতে হবে : কিতাব পড়াতে হবে এমনভাবে যাতে ছাত্র বুঝতে শেখে, চিন্তা করতে শেখে। সমাজের সমস্যার ইসলামী সমাধান খুঁজতে শেখে।
৩. ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে : দেওবন্দের চেতনা বিভাজন নয়, ঐক্য। সব বোর্ড, সব মাদ্রাসা এক উদ্দেশ্যে- আল্লাহর খেদমত ও ইসলামের প্রসার; এ লক্ষ্যে এক হতে হবে।
৪. সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে হবে : কওমি আলেমদের সমাজে নৈতিক নেতৃত্ব নিতে হবে। স্কুল, কলেজ, অফিস, মিডিয়া- সর্বত্র ইসলামী আদর্শ তুলে ধরতে হবে।
৫. দাওয়াত ও গবেষণাকে জীবিত করতে হবে : দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রদের কেবল সনদ নয়, গবেষণা ও দাওয়াতের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা যুক্তি ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ আলেম হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, কওমি মাদ্রাসা শুধু ইতিহাস নয়; এটি আমাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আমরা যদি দেওবন্দের সেই সত্যিকারের রুহ- জ্ঞান, বিনয়, আমল ও আত্মশুদ্ধি ফিরে না পাই, তবে এই ধারার ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে।
আজও অনেক ছাত্র আছেন যারা কওমি মাদরাসা থেকে দাওরাহ হাদিস শেষ করে শুধু আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য। এটি একদমই যথোপযুক্ত নয়। দেওবন্দ ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র, ত্যাগের প্রতীক। আমাদেরও ফিরে যেতে হবে সেই মূল চেতনায়- যেখানে শিক্ষক আল্লাহর খেদমতে নিয়োজিত থাকেন, আর ছাত্র নিজেকে গড়ে তোলে আল্লাহর সৈনিক হিসেবে।
আসুন, নিজেদের প্রশ্ন করি- আমরা কি দেওবন্দের সন্তান হিসেবে সত্যিকারভাবে বেঁচে আছি? নাকি কেবল দেওবন্দের নাম ব্যবহার করে আত্মতুষ্টিতে ভুগছি?
সত্যিকারের দেওবন্দি হতে হলে আমাদের ফিরতে হবে বিনয়, খেদমত ও আত্মশুদ্ধির পথে। যে পথ দেখিয়েছিলেন কাসেম নানুতুবী, গাঙ্গোহী ও আশরাফ আলী থানভী (রহিমাহুমুল্লাহ)। সেই পথেই নিহিত কওমি শিক্ষার পুনর্জন্ম, ইসলামের পুনরুজ্জীবন এবং এই জাতির মুক্তি।
লেখক : লেখক ও ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার

