কওমি শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরতা ইসলামী জাগরণের নতুন দিগন্ত
মাওলানা জাকারিয়া আহমাদ
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২২
বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থান কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। বৈশ্বিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মিডিয়ার প্রায় পুরো দখল অমুসলিম শক্তির হাতে। আমরা প্রতিদিন তাদের তৈরি পণ্য ব্যবহার করি, তাদের প্রযুক্তি কাজে লাগাই, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা অনুসরণ করি। ফলত আমরা অজান্তেই তাদের প্রভাবকে শক্তিশালী করছি।
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকব, ততক্ষণ তারা আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। অথচ ইসলাম চায় মুসলমান হোক নেতৃত্বদাতা জাতি, প্রভাব বিস্তারকারী উম্মাহ। আমরা অনুসারী নয়, বরং পথপ্রদর্শক। এজন্য আমাদের প্রয়োজন সচেতন ও দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলা- যারা জ্ঞানেও এগিয়ে থাকবে, প্রযুক্তিতেও পারদর্শী হবে এবং আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
একবার আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন- “আমরা যদি রাশিয়া, ভারত বা পাকিস্তানের কাছ থেকে অস্ত্র কিনি, তারা কখনোই আমাদের এমন অস্ত্র দেবে না, যা আমরা তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারি।”
এই সত্য শুধু অস্ত্রের ক্ষেত্রেই নয়; জীবন ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অমুসলিমরা কখনো চাইবে না মুসলিমরা তাদের চেয়ে প্রভাবশালী হোক। তাই আমাদের নিজেদের হাতেই তৈরি করতে হবে জ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও শক্তি।
কওমি ছাত্রদের অবমূল্যায়ন : দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের প্রায়ই “অযোগ্য” বা “অকার্যকর” ধরা হয়। যুক্তি হলো- সরকারি সনদ নেই, আধুনিক কোনো দক্ষতা নেই, সমাজে ভূমিকা রাখতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই ছাত্ররা কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও ইসলামী জ্ঞানে নিপুণ। তারা নৈতিকতা, ধৈর্য, আত্মত্যাগ ও আল্লাহভীতি নিয়ে গঠিত। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান যথেষ্ট নয়; প্রযুক্তি, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছাড়া তারা বৃহৎ প্রভাব রাখতে পারবেন না।
দক্ষতার সঙ্গে ইসলামের সমন্বয় : প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। কওমি ছাত্রদেরকে শেখানো যেতে পারে বাস্তব জীবনের দক্ষতা- কম্পিউটার, ডিজিটাল লিটারেসি, ইংরেজি ভাষা, আরবি অনুবাদ, ইসলামী মিডিয়া ও লেখালেখি, সামাজিক নেতৃত্ব, দাওয়াহ মিডিয়া পরিচালনা, হিসাবরক্ষণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ। একজন আলেম যদি এই দক্ষতাগুলো অর্জন করেন, তিনি ইসলামের বার্তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে পৌঁছে দিতে পারবেন। বিভ্রান্ত তরুণ সমাজকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। নিজ দেশের, মুসলিম উম্মাহর এবং বিশ্বের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।
আত্মনির্ভর মুসলিম সমাজ : যদি আমরা সারাজীবন অমুসলিমদের তৈরি পণ্য ব্যবহার করি, প্রভাব থাকবে তাদের হাতে। কিন্তু যদি মুসলিম তরুণরা নিজেদের প্রোডাক্ট, প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি তৈরি করে, একদিন তারা বিশ্বের বাজারের কর্ণধার হবে। তখন ইসলামের দাওয়াহ ও সমাজগঠনকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে সক্ষম হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” (সহিহ মুসলিম) এই শক্তি কেবল শারীরিক নয়; জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রভাব বিস্তারের শক্তিও।
নতুন দিগন্তের আহ্বান : কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজন একটি নবজাগরণ- যেখানে কুরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞান থাকবে, পাশাপাশি থাকবে আধুনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের প্রস্তুতি। ইসলামকে সারা বিশ্বে ছড়ানোর জন্য মুসলিমদের নিজেকেই সক্ষম হতে হবে। যখন কওমি ছাত্ররা শুধু মসজিদ-মাদরাসায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধ ছড়াবে- তখনই মুসলিমরা হবে আত্মনির্ভর, প্রভাবশালী এবং বিশ্বের নেতৃত্বদাতা জাতি।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার ইনস্টিটিউট, মিশর

