Logo

শিক্ষা

কওমিতে আকিদা শিক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন

Icon

মুহাম্মদ হেদায়ত উল্লাহ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩১

কওমিতে আকিদা শিক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন

উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ইসলামি শিক্ষার ধারায় যখন বিপর্যয়ের সঙ্কেত দেখা দেয়, তখন দীনি চেতনা ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব দৃঢ়ভাবে কাঁধে তুলে নেন আলেম সমাজ। উনিশ শতকের শেষ ভাগে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে কওমি ধারার সূচনা হয়, তা পরবর্তীতে গোটা ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো সেই ঐতিহ্যবাহী ধারারই উত্তরসূরি।

এই প্রতিষ্ঠানগুলো যুগে যুগে মুসলিম সমাজের ঈমান, আকিদা, আমল ও নৈতিকতার দুর্গ হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন, ইসলামী চেতনা জাগরণ, সমাজসেবা ও মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রমে কওমি মাদরাসার অবদান অনস্বীকার্য। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও আজ এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিনা পারিশ্রমিকে ও নিঃস্বার্থভাবে দীনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চিন্তাধারা, মতবাদ ও সাংস্কৃতিক প্রবাহ ইসলামী সমাজে প্রভাব ফেলছে। নাস্তিক্যবাদ, বস্তুবাদ, লিবারেলিজম, নারীবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবাহ তরুণ প্রজন্মের মনে প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এই প্রেক্ষাপটে কওমি মাদরাসাগুলোকেও সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্য ও প্রভাব ধরে রাখতে হবে- বিশেষ করে আকিদা শিক্ষার ক্ষেত্রে।

আকিদা শিক্ষার গুরুত্ব ও ঈমানের শুদ্ধতা

আকিদা হলো ইসলামের ভিত্তি। আকিদা শুদ্ধ না হলে ঈমানদার হওয়া যায় না। যত আমলই করা হোক না কেন, আকিদা যদি বিভ্রান্ত বা ভুল হয়, তবে সেই আমল আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হয় না। যেমন ইমাম তাহাবি (রহ.) বলেছেন-  “আকিদা সঠিক না হলে আমল অর্থহীন।”

বিশুদ্ধ আকিদা মানুষের জীবনের চূড়ান্ত সফলতা নিশ্চিত করে, কারণ এটি সকল ইবাদত ও শরিয়াহ পালনের পূর্বশর্ত। ঈমান-আকিদা সঠিক না হলে নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না। আমৃত্যু বিশুদ্ধ আকিদা ধারণ করে ইসলামী শরিয়াহর পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন করার মধ্যেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সফলতা নিহিত। বিশুদ্ধ আকিদা ধারণ করা বান্দার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা। এটি মানুষের চিন্তা, চেতনা এবং কর্মকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। আকিদা মানুষকে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান হিসেবে মানতে এবং শিরকমুক্ত থাকতে শেখায়।

তাই কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য আকিদা শিক্ষাকে কেবল একটি পাঠ্যবিষয় হিসেবে নয়, বরং জীবনের ভিত্তি হিসেবে শেখানো উচিত। নিয়মিত পাঠ, গবেষণা ও তত্ত্বচর্চার মাধ্যমে এই জ্ঞানকে গভীর করা জরুরি। কওমি মাদরাসা জাতির ঈমানি শক্তির মূল উৎস। কিন্তু যদি আকিদা শিক্ষা কেবল প্রাচীন গ্রন্থের ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও চেতনায় তার গভীর প্রভাব সৃষ্টি করা কঠিন হবে। ইসলামি আকিদা এক চিরন্তন সত্য, তবে তার উপস্থাপন হতে হবে সময়োপযোগী, যুক্তিনির্ভর ও বাস্তবমুখী।

বর্তমান পাঠ্যক্রমের সীমাবদ্ধতা

বর্তমানে কওমি মাদরাসায় আকিদা বিষয়টি মূলত দুটি বিখ্যাত গ্রন্থের মাধ্যমে পড়ানো হয়- ‘আকীদাতুত তাহাবী’ ও ‘শারহুল আকায়িদ’। শিক্ষার্থীরা ইসলামি আকিদার মৌলিক নীতিগুলো বুঝলেও আধুনিক চিন্তার বিভ্রান্তির মোকাবেলায় তেমন প্রস্তুতি নিতে পারে না। তাছাড়া অনেক মাদরাসায় আকিদা ক্লাসগুলোতে গবেষণামূলক আলোচনার সুযোগ থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীরা কেবল পড়ে যায়, কিন্তু বিষয়টি হৃদয়ে ধারণ করার তেমন সুযোগ পায় না।

সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

১. পাঠ্যক্রমে বৈচিত্র্য ও ধাপভিত্তিক শিক্ষা : প্রাথমিক ও মধ্যম স্তর থেকেই সহজ ভাষার আকিদা বিষয়ক বই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যেমন- তাওহিদ, নবুয়ত, আখিরাত, ফেরেশতা, তাকদির প্রভৃতি বিষয়ে ধাপে ধাপে শিক্ষা দেওয়া। এতে শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতা বাড়বে এবং আকিদা তাদের চেতনায় বাস্তব রূপ পাবে।

২. সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ অন্তর্ভুক্তকরণ : আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞানবাদ, নাস্তিক্যবাদ, লিবারেলিজম ও ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আকিদা শিক্ষা হতে হবে যুক্তিনির্ভর ও বাস্তবধর্মী। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে—ইসলামি আকিদা কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক সত্য।

৩. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠদানের আধুনিকীকরণ : আকিদা শিক্ষকদের আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা সম্পর্কে অবগত করা জরুরি। এজন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। শিক্ষকরা যেন আকিদা এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে তা বুদ্ধি, বিজ্ঞান ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়।

৪. অতিরিক্ত আকিদা গ্রন্থ সংযোজন : প্রচলিত দুটি গ্রন্থের পাশাপাশি সহজ ও সমসাময়িক ভাষায় রচিত আরও কিছু আকিদা বই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আকিদা বিষয়ে গভীর ও বিস্তৃত ধারণা লাভ করবে।

লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা, দশমিনা, পটুয়াখালী, বরিশাল।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর