বিশেষ সাক্ষাৎকার
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পাকিস্তানে স্বাগতম
মুফতি ইহসান ওয়াকার আহমাদ
ইনজামামুল হক
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:০৮
গত অক্টোবর-২৫ এর শেষের দিকে এক সপ্তাহের জন্য দ্বীনি ও শিক্ষা সেমিনার বিষয়ক সফরে বাংলাদেশে আসেন পাকিস্তানের হযরত মুফতি ইহসান ওয়াকার আহমাদ। তিনি জামিয়াতুর রশিদ করাচির মুহাদ্দিস এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান। সফর চলাকালীন তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশের খবরের সহসম্পাদক মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক।
বাংলাদেশি কওমি শিক্ষার্থীদের পাকিস্তানে অধ্যয়নের সুযোগসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের খবর-কে বিশেষ এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এক্সক্লুসিভ এই উর্দু সাক্ষাৎকারটি বাংলায় রূপান্তর করে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের খবর : আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : ওয়াআলাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি।
বাংলাদেশের খবর : আপনি এখন বাংলাদেশ সফরে আছেন, এখানকার মানুষদের কেমন লাগছে আপনার? তাদের আতিথেয়তা সম্পর্কে কী বলবেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জি, আলহামদুলিল্লাহ, এখানে আসার পর অনেক আন্তরিকতা অনুভব করছি। মানুষজনের মধ্যে প্রচুর ভালোবাসা আছে, মাশাআল্লাহ। সবাই অত্যন্ত সম্মান দেখিয়েছে। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। সবাই খুব আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশের খবর : ইতিপূর্বে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন এবং এখনো যাচ্ছেন। বাংলাদেশি ছাত্রদের সম্পর্কে আপনার মতামত কী? তাদের ইলম, আমল ও মানসিকতার বিষয়ে কিছু বলুন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জি, মাশাআল্লাহ। বাংলাদেশ থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমার মতে, আমরা পাকিস্তানে যে অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থা তৈরি করেছি, তা থেকে বাংলাদেশেরও পূর্ণ উপকার নেওয়া উচিত। এতে দুই দেশের মধ্যে ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। জ্ঞানচর্চার যে ক্ষেত্রে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি ও সফল হয়েছি, সেটি আমরা আমাদের বন্ধু দেশকে দিতে চাই। যেন তারা উপকৃত হতে পারে। সেটা হোক মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় অথবা প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে; সবখানেই সহযোগিতা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আসুক, আমরা তাদের আন্তরিকভাবে বরণ করব। আমরা যা শিখেছি, বুঝেছি; সব তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবো।
বাংলাদেশের খবর : বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের থেকে পাকিস্তানের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অনেকাংশেই এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য আপনার কি পরামর্শ থাকবে?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : আমার মতে, সামাজিকভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় একই রকম। হ্যাঁ! সেখানে মাদরাসা ও মূলধারার শিক্ষার মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ, পাকিস্তান অনেক দিকেই এখন উন্নতি হয়েছে। নানা খাতে কাজ এগোচ্ছে। অনেক সাধারণ স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ইলমে দীন অর্জন করছে। একইভাবে মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও জেনারেল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মূলধারায় যুক্ত হচ্ছে। তাই আমার মতে, বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব, এখানকার মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরও এই প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা গ্রহণ করা।
কারণ তারা যদি পিছিয়ে পড়ে, তাহলে বাইরের কেউ এসে সেই জায়গা দখল করবে। তাই দ্রুত বিষয়টি উপলব্ধি করে এর প্রতি মনোযোগী হওয়া ও যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনে পাকিস্তানে এসে পড়াশোনা করতে পারে অথবা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সহযোগিতা নিতে পারে। আমরা আল-গাজালি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আমন্ত্রণ জানাই, তারা যেন আসে। তাছাড়া জামিয়াতুর রশিদেও আসতে পারে। সেখানে বিভিন্ন বিশেষ কোর্স ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। এরপর দেশে ফিরে নিজ জাতির সেবা করবে। এতে সমাজের জন্য দারুণ অবদান রাখা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের খবর : আপনি জামিয়াতুর রশিদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ওই মাদরাসা সম্পর্কে কিছু বলুন, ওখানকার শিক্ষার্থীরা কীভাবে পাকিস্তানের জনগণের জন্য কাজ করছেন? আমরা শুনেছি, জামিয়াতুর রশিদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সরকারি চাকরি করছে; এমনকি সেনাবাহিনীতেও। এই বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত বলুন।
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জী, আলহামদুলিল্লাহ! জামিয়াতুর রশিদের একটি ব্যাপক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভিশন ছিল। আজ থেকে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আগেই আমাদের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা এই বিষয়টি অনুমান করেছিলেন- যদি সমাজে আমাদের কাজ করতে হয়; তাহলে সমাজের ধরণ, পদ্ধতি ও বাস্তবতাকে এমনভাবে বুঝতে হবে, যাতে আমরা তাদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারি।
অতঃপর তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করলেন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আহ্বান জানালেন, তারা এসে যেন দীনের জ্ঞান অর্জন করুক। তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে 'কুল্লিয়াতুস শরীয়াহ' নামে চার বছরের একটি ইসলামী শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করা হলো। এরপর ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। অনেক শিক্ষার্থী আসতে শুরু করল। ভালো মানের শিক্ষার্থী- যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী; এদের অনেকেই এই চার বছরের প্রোগ্রামে ভর্তি হতে লাগল। পড়াশোনা শেষ করে তারা যখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে ফিরে গেল; তখন কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দিল, কেউ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করল, কেউ নিউক্লিয়ার এনার্জি নিয়ে কাজ করল, কেউ শিক্ষাক্ষেত্রে সেবা দিতে লাগল। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও গেল।
এর ফলস্বরূপ সমাজে এক ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে শুরু করল। একইভাবে, মাদরাসার ছাত্রদেরও জেনারেল ও পেশাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হলো। তাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও জ্ঞান প্রদান করা হলো। ফলে তারা এমন যোগ্যতা অর্জন করল যে, তারা বিভিন্ন বাহিনীতে সুযোগ পেল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেবা দিতে লাগল। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ফাইনান্স বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামিক ব্যাংক, বীমা কোম্পানি; এসবে কাজ করার সুযোগ উন্মুক্ত হল।
আর যেখানে তারা কাজ করছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উপর আস্থা রাখতে আরম্ভ করল। তারা বুঝছে পারল, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত যোগ্যতা রয়েছে; যারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারে। তাই আমার ধারণা, যদি এ ধরণের কাজ বাংলাদেশেও শুরু হয়, তাহলে তা অত্যন্ত উপকারী হবে। ছাত্ররা সমাজের মানুষদের সেবা দিতে পারবে। আমার বিশ্বাস, এটি হবে একটি জাতি পুনর্গঠনের কাজ।
বাংলাদেশের খবর : আলহামদুলিল্লাহ! অনেক্ষণ আমাদের সময় দিয়েছেন। অনেক কিছু জানতে পারলাম আমরা। জাযাকাল্লাহ। সবশেষে মিডিয়ার ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জ্বি, আমি মিডিয়ার বিষয়ে শুধু এটুকু বলতে চাই- যতটা সম্ভব ইতিবাচক খবর প্রচার করুন। মানুষকে জানান, দেশে কত ভালো কাজ হচ্ছে। যাতে মানুষের মধ্যে আস্থা জন্মায় এবং তারা হতাশ না হয়। কারণ সাধারণত যখন নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে পড়ে তখন মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। তাই মিডিয়ার একটি বড় দায়িত্ব হলো- সত্য খবর সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া। যাতে জনগণ আশাবাদী থাকে এবং আত্মবিশ্বাস ধরে রাখে। আর যেন এটা উপলব্ধি করতে পারে- দেশে কাজ হচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই উপকার হবে, ইনশাআল্লাহ।

