Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরাসা বনাম মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি

Icon

খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৫০

কওমি মাদরাসা বনাম মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার মূলভিত্তি হিসেবে কওমি মাদরাসা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সমাজে নৈতিকতা, মানবিকতা ও ইসলামি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায়-  মূলধারার মিডিয়া ও কিছু আধুনিক শিক্ষিত গোষ্ঠী কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায়ই সন্দেহ, সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রোপাগান্ডার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলে। অন্যদিকে একই সময়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অপরাধ, নৈতিক অবক্ষয় ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু তা তুলনামূলকভাবে আড়ালে থেকে যায়।

কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত চিত্র

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৯,০০০২০,০০০ নিবন্ধিত কওমি মাদরাসা রয়েছে। আর অনিবন্ধিতসহ এই সংখ্যা প্রায় ৭০,০০০-এরও বেশি। এগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুমানিক ২৫-৩০ লক্ষ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা, খাবার ও আবাসন প্রদান করে।

কওমি মাদরাসার মূল লক্ষ্য শুধু জ্ঞান অর্জন নয়, বরং চরিত্রগঠন, নৈতিকতা, পরহেজগারি ও সমাজসেবা। অনেক সচেতন পরিবারও তাদের সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করছেন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নতুন নতুন প্রাইভেট আধুনিক কওমী মাদরাসাও গড়ে উঠছে।

মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি, পক্ষপাত ও প্রোপাগান্ডা :

বাংলাদেশের প্রধান ধারার মিডিয়া— বিশেষ করে কিছু টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকা কওমি মাদরাসাকে প্রায়ই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। একজন মাদরাসা শিক্ষার্থীর কোনো অপরাধ বা ভুল কাজ পুরো মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার উপর দোষারোপ হিসেবে প্রচার পায়। অন্যদিকে একই ধরনের বা আরও ভয়াবহ অপরাধ কোনো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘটলে সেটি “ব্যক্তিগত অপরাধ” হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

এই প্রবণতা মূলত কিছু সেক্যুলার ও পশ্চিমমুখী চিন্তাধারার ফল, যেখানে ইসলামী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ধ্বংস করে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ দুর্বল করার একটি গোপন পরিকল্পনা কাজ করে। ফলাফল- সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়, আর মাদরাসা শিক্ষিত আলেম সমাজ অযথা বদনাম বহন করে।

সমাজে নেতিবাচক প্রভাব :

মিডিয়ার এই ধারাবাহিক প্রচারণা সমাজে কয়েকটি বড় প্রভাব ফেলেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্ত ও আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে। ইসলামী পোশাক, দাড়ি-টুপি পরিহিত মানুষকে অনেকেই “রক্ষণশীল” বা “অগ্রগতির বিরোধী” হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। কওমী শিক্ষার্থীরা চাকরি ও সামাজিক অঙ্গনে অবহেলার শিকার হচ্ছে। এই সুযোগে ধর্মবিরোধী ও নাস্তিক গোষ্ঠী ইসলামবিরোধী প্রচারণা জোরদার করছে। যা নৈতিক সমাজ গঠনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

অপরাধ প্রবণতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ :

বাস্তবে দেখা যায়- খুন, ধর্ষণ, মাদক, চাঁদাবাজি, হানিট্র্যাপ, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, ঘুষ, যৌন হয়রানি, আত্মহত্যা ও অশ্লীলতা; এসব অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া তরুণদের মধ্যে। অপরদিকে কওমি মাদরাসাভিত্তিক অপরাধের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত নগণ্য। কারণ, এখানকার শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই আল্লাহভীতি, শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পায়। কিন্তু মিডিয়ার চোখে এই বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় না। বরং একটি বিচ্ছিন্ন মাদরাসা-সংক্রান্ত ঘটনা এমনভাবে প্রচারিত হয় যেন গোটা ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থাই অপরাধের উৎস।

সুদ ও এনজিও খাতের বাস্তবতা

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ এনজিও-নির্ভর ঋণ ব্যবস্থায় জড়িত, যা সম্পূর্ণ সুদভিত্তিক (ওহঃবৎবংঃ-নধংবফ)। এই বিশাল অর্থনৈতিক কাঠামো পরিচালনা করছে জেনারেল শিক্ষিত শ্রেণি; কওমি বা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এখানে কার্যত অনুপস্থিত।

অধিকাংশ এনজিও পশ্চিমা অর্থায়নে পরিচালিত হয়, যেখানে ইসলামী অর্থনীতি বা সুদবিরোধী কার্যক্রমের কোনো স্থান নেই। ফলে সমাজে সুদভিত্তিক অর্থনীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী কওমি শিক্ষিত কেউ নয়। বরং তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণিই মূল ভূমিকা রাখছে।

ইসলামী শিক্ষার ইতিবাচক অবদান

কওমি মাদরাসাগুলো নীরবে বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে এক বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে ইমাম, খতিব ও শিক্ষক হিসেবে সেবা দিচ্ছেন। হিফজখানা ও মক্তবের মাধ্যমে শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিচ্ছেন। সমাজে দান, যাকাত, নৈতিকতা ও মানবিকতা জাগ্রত করছেন। কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা ছাড়াই দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এটাই প্রকৃত “মানবিক শিক্ষা”, যা সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে টিকিয়ে রেখেছে।

উপসংহার

কওমি মাদরাসা আজও বাংলাদেশের নৈতিকতা ও ইসলামী চেতনার প্রধান আশ্রয়স্থল। মিডিয়ার দায়িত্ব থাকা উচিত- শুধুমাত্র ভুলত্রæটি নয়, বরং ইতিবাচক অবদানগুলোও ন্যায্যভাবে তুলে ধরা।

অপরাধ, দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কওমী শিক্ষার্থীরা নয়, বরং তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণিই বেশি জড়িত - এটাই বাস্তবতা। যে সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা দুর্বল হয়, সেই সমাজেই নৈতিক অবক্ষয় বাড়ে; ইতিহাস তার সাক্ষী। সুতরাং মিডিয়ার উচিত পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামী শিক্ষা ও কওমী মাদরাসার ভূমিকা স্বীকার করা। এই স্বীকৃতিই একটি নৈতিক, শান্তিপূর্ণ ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন বাংলাদেশ গঠনের পথকে সুগম করবে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হেমায়েতপুর, সাভার, ঢাকা

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর