প্রাথমিক শিক্ষকদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি
মো. কামরুজ্জামান
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:২৪
উপমডিউল ১.৫: বিদ্যালয় উন্নয়ন
৯। সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন (৩টি হতে যে কোন ২টি)
(ক) কার্যকর ক্লাস রুটিন কেন প্রয়োজন?
উত্তর: কার্যকর ক্লাস রুটিন প্রয়োজন কারণ: ১. এটি বিদ্যালয়ে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে এবং সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে।
২. এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ; তারা জানে কখন কোন বিষয় পড়া হবে, যা তাদের মনোযোগী হতে সাহায্য করে।
৩. কঠিন বিষয় যেমন: গণিত, ইংরেজি) এবং তুলনামূলক সহজ বা আনন্দদায়ক বিষয় (যেমন: চারুকারু, সংগীত, খেলাধুলা) এর মধ্যে ভারসাম্য রেখে রুটিন করলে তা শিখনকে আনন্দদায়ক করে।
৪. বিদ্যালয়ের ভৌত সম্পদ (যেমন: লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম) ও শিক্ষকদের দক্ষতার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে।
(খ) শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস গঠনে পাঠাগারের ভূমিকা লিখুন।
উত্তর: শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস গঠনে পাঠাগারের ভূমিকা অপরিসীম।
১. পাঠাগার পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় শিশুতোষ বই (যেমন: গল্প, ছড়া, বিজ্ঞান, কমিকস) সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
২. এটি শিক্ষার্থীদের একটি নিরিবিলি ও মনোরম পরিবেশ দেয়, যেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারে।
৩. লাইব্রেরি পিরিয়ড বা বিভিন্ন কর্মসূচি (যেমন: বই পড়া প্রতিযোগিতা, বুক রিভিউ) শিক্ষার্থীদের বই পড়তে উৎসাহিত করে।
৪. পাঠাগারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেভাবে (নিজে নিজে) বই নির্বাচন করতে শেখে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসী পাঠক হিসেবে গড়ে তোলে এবং তাদের কল্পনাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে।
(গ) বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকার ম্যাপের প্রয়োজনীয়তা লিখুন।
উত্তর: বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকার ম্যাপের প্রয়োজনীয়তা নি¤œরূপ:
১. বিদ্যালয়ের ভর্তিযোগ্য সকল শিশুর সঠিক তথ্য ও অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। ২. ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়া (উৎড়ঢ়-ড়ঁঃ) এবং বিদ্যালয়ে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা সহজ হয়।
৩. শিক্ষার্থীদের বাড়ি পরিদর্শনের (ঐড়সব ঠরংরঃ) পরিকল্পনা করতে এবং তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে এই ম্যাপ অপরিহার্য।
৪. বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সম্পদ ( যেমন: শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, সম্ভাব্য দাতা) এবং ঝুঁকিগুলো (যেমন: নদী, অনিরাপদ রাস্তা) চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
১০। বিস্তৃত উত্তর প্রশ্ন (২টি হতে যে কোন ১টি)
(ক) ‘ঝরে পড়া’ রোধে বিদ্যালয়ে আপনি কী কী কার্যক্রম অনুশীলন করবেন বিস্তারিত লিখুন। উত্তর: ‘ঝরে পড়া’ (উৎড়ঢ়-ড়ঁঃ) প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এটি রোধে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নি¤েœাক্ত কার্যক্রমগুলো অনুশীলন করবো:
১. ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষার্থী চিহ্নিতকরণ: নিয়মিত উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যেসব শিক্ষার্থী ঘনঘন অনুপস্থিত থাকে, তাদের একটি তালিকা তৈরি করবো। পাশাপাশি, যারা শিখনে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে বা পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত, তাদেরও বিশেষভাবে চিহ্নিত করবো।
২. আনন্দদায়ক পাঠদান: শ্রেণিকক্ষে গতানুগতিক বক্তৃতার বদলে খেলাধুলা, গান, গল্প এবং বিভিন্ন শিক্ষাউপকরণ ব্যবহার করে পাঠদানকে আনন্দদায়ক ও শিশুকেন্দ্রিক করে তুলবো, যেন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে আগ্রহী হয়।
৩. শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সম্পূর্ণ পরিহার: বিদ্যালয়ের পরিবেশকে ভীতিমুক্ত রাখবো। কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি প্রদান থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকবো এবং একটি নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করবো। ৪. নিয়মিত অভিভাবক যোগাযোগ ও হোম ভিজিট: অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করবো। প্রয়োজন হলে, এসএমসি সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীর বাড়ি পরিদর্শন (ঐড়সব ঠরংরঃ) করে সমস্যার মূল কারণ ( যেমন: দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ) খুঁজে বের করবো এবং তাদেরকে সচেতন করবো।
৫. সহায়তামূলক কার্যক্রম: পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদাভাবে যতœ নেব এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত বা নিরাময়মূলক (জবসবফরধষ) ক্লাসের ব্যবস্থা করবো।
৬. সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ: শিক্ষার্থীরা যেন সময়মতো উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই, স্কুল ফিডিং (টিফিন) ইত্যাদি সরকারি সুবিধা পায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবো।
১১। বিস্তৃত উত্তর প্রশ্ন (২টি হতে যে কোন ১টি)
(খ) বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বান্ধব পরিবেশ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা কী কী? একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রতিবন্ধকতাসমূহ উত্তরণে আপনার ভূমিকা বিশ্লেষণ করুন। উত্তর: শিক্ষার্থী বান্ধব পরিবেশ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা: একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বান্ধব (শিশুবান্ধব) পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো:
১. ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যা: জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষ, বসার বেঞ্চের অভাব, অপরিচ্ছন্ন ও অপর্যাপ্ত শৌচাগার (বিশেষত ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের অভাব), বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব এবং খেলার মাঠের অভাব।
২. শিক্ষকের গতানুগতিক মানসিকতা: অনেক শিক্ষকের শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলের উপর জোর দেওয়া।
৩. ভীতি ও শাস্তিমূলক পরিবেশ: বিদ্যালয়ে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রচলন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয় সম্পর্কে ভীতি তৈরি করে।
৪. শিক্ষক-শিক্ষার্থী দূরত্ব: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের অভাব, যার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো মন খুলে বলতে পারে না।
৫. সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভাব: পাঠ্যবইয়ের বাইরে খেলাধুলা, সংগীত, চিত্রাঙ্কন বা সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ না থাকা।
৬. সচেতনতার অভাব: অভিভাবক এবং অনেক সময় এসএমসি সদস্যদের শিশুবান্ধব পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব।
অতিক্রমণে প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা: একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে (যিনি একজন একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতা) এই প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে আমার ভূমিকা হবে বহুমুখী:
১. নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা: প্রথমত, আমি সকল শিক্ষক ও এসএমসি-কে নিয়ে একটি শিশুবান্ধব পরিবেশের রূপরেখা তৈরি করবো। বিদ্যালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (ঝখওচ)-এ অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো (যেমন: টয়লেট মেরামত, পানির ব্যবস্থা) সমাধানের জন্য বাজেটকে অগ্রাধিকার দেবো।
২. মানসিকতার পরিবর্তন (চবফধমড়মরপধষ খবধফবৎংযরঢ়): আমি নিজে আনন্দদায়ক ও শিশুকেন্দ্রিক পাঠদান অনুশীলন করে সহকর্মীদের জন্য ‘মডেল’ হবো। ইন-হাউস প্রশিক্ষণের আয়োজন করবো। শিক্ষকদের ক্লাসে খেলাধুলা, শিক্ষাউপকরণ ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে কাজ করতে উৎসাহিত করবো।
৩. ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ: বিদ্যালয়ে ‘শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ’ এই মর্মে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করবো এবং তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবো।
৪. সম্পর্ক উন্নয়ন: আমি নিয়মিত শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন করবো, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবো, তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনবো এবং শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক তৈরিতে উৎসাহ জোগাবো।
৫. সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু: রুটিনে খেলাধুলা, গান, আঁকা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করবো। বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করবো।
৬. অংশীজনদের সম্পৃক্তকরণ: অভিভাবক সমাবেশ ও এসএমসি মিটিং-এ শিশুবান্ধব পরিবেশের গুরুত্ব তুলে ধরবো।
তাদের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা, বাগান করা ইত্যাদি কাজে সম্পৃক্ত করে বিদ্যালয়ের প্রতি তাদের মমত্ববোধ তৈরি করবো।
লেখক : সুপার, ঢাকা পিটিআই

