প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করতে সমন্বিত কৌশল
মো. কামরুজ্জামান
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:২১
বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলা কেবল শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ানো বা ঝরে পড়া রোধ করার জন্যই নয়, বরং শিশুদের জন্য একটি আনন্দদায়ক ও কার্যকর শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করার জন্য কিছু সমন্বিত কৌশল নিচে তুলে ধরা হলো:
১. ভৌত অবকাঠামো ও নান্দনিক পরিবেশ
রঙিন ও শিক্ষামূলক বিদ্যালয় ভবন: বিদ্যালয়ের ভবন, শ্রেণিকক্ষ এবং সীমানাপ্রাচীর আকর্ষণীয় রঙে রাঙানো এবং তাতে শিক্ষামূলক চিত্র (যেমন: বর্ণমালা, মনীষীদের উক্তি, বিজ্ঞানের চিত্র, মানচিত্র) আঁকা যেতে পারে।
পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি: শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত, পরিচ্ছন্ন এবং পৃথক (ছেলে ও মেয়েদের জন্য) টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এজন্য ছাত্র সংখ্যা অনুযায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মীর ব্যবস্থা করতে হবে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের সহজলভ্যতা অত্যন্ত জরুরি।
সবুজায়ন ও বাগান: বিদ্যালয়ের আঙিনায় বাগান করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই গাছের যত্ন নিতে পারে। এটি পরিবেশগত শিক্ষার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে।
খেলার মাঠ ও উপকরণ: একটি পরিপাটি খেলার মাঠ এবং খেলাধুলার পর্যাপ্ত উপকরণ (ফুটবল, ক্রিকেট সরঞ্জাম, দোলনা ইত্যাদি) শিশুদের বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
২. শিক্ষাদান পদ্ধতিতে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য
আনন্দদায়ক পাঠদান: গতানুগতিক মুখস্থ-নির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে খেলাধুলা, গান, অভিনয় এবং গল্পের মাধ্যমে পাঠদান (Activity-based Learning) চালু করা।
প্রযুক্তির ব্যবহার: প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্তত একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নিশ্চিত করা, যেখানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষামূলক ভিডিও, অ্যানিমেশন ও প্রেজেন্টেশন দেখানো যায়।
সহ-শিক্ষা কার্যক্রম: পড়াশোনার পাশাপাশি আঁকাআঁকি, গান, নাচ, আবৃত্তি, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
শিশুতোষ লাইব্রেরি: আকর্ষণীয় ও সচিত্র শিশুতোষ বই দিয়ে একটি লাইব্রেরি তৈরি করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারে।
৩. শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্য
শিশুবান্ধব আচরণ: শিক্ষকরা হবেন শাসনকারী নয়, বরং বন্ধুর মতো। শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন না করে উৎসাহ ও প্রশংসা করার একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা।
কাউন্সেলিং ও সাপোর্ট: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো শোনার জন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া বা খণ্ডকালীন কাউন্সেলরের ব্যবস্থা করা।
বুলিং প্রতিরোধ: বিদ্যালয়ে র্যাগিং বা বুলিং (সহপাঠীদের উত্ত্যক্ত করা) সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য কঠোর তদারকি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
৪. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও প্রণোদনা
আধুনিক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের কেবল বিষয়ভিত্তিক নয়, বরং শিশু মনোবিজ্ঞান, আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর নিয়মিত উচ্চমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার: ভালো পারফরম্যান্সকারী শিক্ষক ও বিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পুরস্কৃত করা।
৫. কমিউনিটি ও অভিভাবক সম্পৃক্ততা
অভিভাবক সমাবেশ: নিয়মিত বিরতিতে অভিভাবক-শিক্ষক সভার (Parent-Teacher Meeting) আয়োজন করা, যেখানে শুধু অভিযোগ নয়, বরং শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য পারস্পরিক মতামত বিনিময় হয়।
কমিউনিটির অংশগ্রহণ: বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে এবং অনুষ্ঠানে (যেমন: বার্ষিক ক্রীড়া, বৃক্ষরোপণ) স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা।
মা সমাবেশ (Mothers’ Gathering): মায়েদের নিয়ে নিয়মিত সভার আয়োজন করে সন্তানের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৬. বিশেষ ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ
মিড-ডে মিল: সকল বিদ্যালয়ে মানসম্মত দুপুরের খাবার বা টিফিনের (মিড-ডে মিল) ব্যবস্থা করা। এটি কেবল পুষ্টিহীনতা দূর করবে না, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বাড়াবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত ( যেমন: প্রতি তিন মাসে একবার) শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট বিতরণের ব্যবস্থা করা।
ক্ষুদ্র পুরস্কার: নিয়মিত উপস্থিতি, পরিচ্ছন্নতা এবং ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট পুরস্কার (যেমন: খাতা, কলম, বই) দিয়ে উৎসাহিত করা।
কম্পিউটার অপারেটর/হিসাব সহকারী নিয়োগ: শিক্ষকদের যেন পাঠদান ব্যতীত অন্য কাজ করা না লাগে।
এই কৌশলগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটি, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লেখক : সুপার, ঢাকা পিটিআই
বিকেপি/এমবি

