সেরাদের তালিকায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ‘দিলুরোড মাদরাসা'
উবায়দুল হক খান
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০১
ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলোর একটি- মগবাজার, রমনা। এখানে অবস্থিত এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার নাম আজ সারা দেশের কওমি অঙ্গনে গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম [দিলুরোড মাদরাসা]। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করা এই মাদরাসা বর্তমানে বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার উৎকর্ষ ও শৃঙ্খলার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । ইসলামি জ্ঞান, চরিত্র গঠন ও সামাজিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ের মধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে সেরাদের তালিকায়।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
২০০৪ খ্রিস্টাব্দ । দেশ তখন সামাজিক পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছোঁয়ায় মানুষ ইসলামি । মূল্যবোধ থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। এমন এক সময়ে একজন আলোকিত আলেম, মেহনতি দাঈ ও দূরদর্শী চিন্তাবিদ আলেম মুফতি সালাহ উদ্দিন উপলব্ধি করেন, সমাজে ইসলামি চেতনা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো কওমি শিক্ষা। তার দূরদৃষ্টি ও আল্লাহভীতির ফসল হিসেবেই জন্ম নেয় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম [দিলুরোড মাদরাসা]। শুরুর দিকে এটি ছিল টিনসেট ঘর, অল্পসংখ্যক ছাত্র ও কয়েকজন শিক্ষকের মিলনে ছোট্ট একটি আলোকিত শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু এর মধ্যে ছিল সওয়াবের বিশুদ্ধ নিয়ত খালেস দ্বীনি চিন্তা। ধীরে ধীরে আল্লাহর রহমতে প্রতিষ্ঠানটি অগ্রসর হতে থাকে- সংখ্যায়, মানে ও মর্যাদায়। আজ এটি দেশের অন্যতম আধুনিক ও ফলপ্রসূ কওমি মাদরাসা হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে কিতাব বিভাগে ৪৩জন, হিফজ ও নুরানি বিভাগে ১৪জন ও ১৬জন স্টাফসহ মোট ৭৩জনের সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে দিলুরোড মাদরাসা।
অবকাঠামো ও পরিবেশ
বর্তমানে দিলুরোড মাদরাসা ১১তলা সুদৃশ্য ভবনে প্রতিষ্ঠিত । ঢাকা শহরের কোলাহলের মধ্যেও এই ভবনটি যেন শান্তি ও প্রশান্তির এক প্রতীক। স্থাপনাটি পরিকল্পিত ও দৃষ্টিনন্দন- প্রতিটি তলায় রয়েছে প্রশস্ত ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, ছাত্রাবাস, হিফজ বিভাগ, শিক্ষক মিলনায়তন, দারুল ইফতা, সম্মেলনকক্ষ ও মসজিদ।
মাদরাসার পুরো ভবনেই পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলার ছাপ স্পষ্ট। পরিবেশটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে একজন ছাত্র শুধু পড়াশোনার মাধ্যমে নয়, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার চর্চার মাধ্যমেও নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।
ছাত্রদের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা, নিয়মিত চিকিৎসা সহায়তা, বিশুদ্ধ পানি এবং আরামদায়ক আবাসন ব্যবস্থা। রাতের শেষ প্রহরে মসজিদ থেকে ভেসে আসে কুরআনের তেলাওয়াত, আর সকালে আজানের ধ্বনিতে পুরো মাদরাসা জেগে ওঠে- এ দৃশ্য যে একবার দেখেছে, সে কখনও ভুলতে পারে না
দাওরায়ে হাদিসের সূচনা
প্রতিষ্ঠার আট বছর পর, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে দিলুরোড মাদরাসায় সূচনা হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা বিভাগ- দাওরায়ে হাদিস। এটি মাদরাসার ইতিহাসে এক মাইলফলক। সূচনালগ্নে দাওরায় বুখারি শরিফের দরস দেন কওমি অঙ্গনের দুই মহিরুহ, মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী ও মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ । তিরমিজির দরস প্রদান করেন মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। তাঁদের দরসদানে এই প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করে এবং সারা দেশে একাডেমিক উৎকর্ষের প্রতীক হয়ে ওঠে। বর্তমানে বুখারির দরস দিচ্ছেন তিনজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস মাওলানা নুরুল ইসলাম আদীব, মাওলানা যিকরুল্লাহ খান ও মাওলানা হাসান জামিল। তাঁরা শুধু শিক্ষকরূপে নয়; বরং মুরব্বি ও আদর্শরূপে ছাত্রদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের দরসে পাঠদান হয় গভীর ব্যাখ্যা ও গবেষণার মাধ্যমে।
জামিয়ার বর্তমান বিভাগসমূহ
১. মক্তব বিভাগ : এ বিভাগে এক বছরের মধ্যে একজন কোমলমতি শিশুকে অত্যন্ত যত্নসহকারে আরবি হরফের সঠিক পাঠ পরিচয় এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ কুরআন পাঠ ও ইসলামের মৌলিক প্রয়োজনীয় মাসায়িল শিক্ষা দেওয়া হয়।
হিফজ বিভাগ: এ বিভাগে মাত্র ৩ বছরে একজন শিশুকে পূর্ণ কুরআন সহিহ-শুদ্ধরূপে মুখস্থ করানো হয় । শুধু মুখে মুখস্থ নয়, তাদের অন্তরে গেঁথে দেওয়া হয় কুরআনের মহান আদর্শ ও উত্তম শিষ্টাচার । কথায় আছে, 'কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। সে হিসেবে যে শিশুটি ভবিষ্যতে জাতিকে আলোর পথ দেখাবে, তাদেরকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করবে, তাকে ছোটবেলা থেকেই এ সবের প্রতি যত্নবান হতে হয়। তাই প্রতিটি শিশুকে যথাযথ আদব, শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সামাজিকতার শিক্ষা দেওয়ার জামিয়ার রয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। সব মিলিয়ে এটি শুধু নিছক হিফজ বিভাগ নয়, এটি হচ্ছে আদর্শ ও আলোকিত মানুষ গড়ার যথাযথ যুগোপযোগী একটি ব্যবস্থাপদ্ধতি
৩. কিতাব বিভাগ : একজন শিক্ষার্থীকে পূর্ণ দীনি শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য আলেমরূপে গড়ে তোলার জন্য জামিয়ায় ৫টি স্তরে মোট ১০ বছর মেয়াদি এ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এটিই জামিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রধান মৌলিক কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের ৫ স্তরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ। ক. ইবতিদাইয়্যাহ [প্রাইমারী] মেয়াদ ২ বছর। খ. মুতাওয়াসসিতাহ [মাধ্যমিক] মেয়াদ ৩ বছর। গ, সানাবিয়্যাহ (উচ্চ মাধ্যমিক] মেয়াদ ২ বছর । ঘ. ফজিলত [ডিগ্রি] মেয়াদ ২ বছর । ঙ. তাকমিল (মাস্টার্স মেয়াদ ১ বছর।
৪. ইফতা বিভাগ : এটি সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ ছাত্রদের জন্য তাখাসসুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা তথা ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ কোর্স। এই বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদিস শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ আলেমদেরকে যুগসমস্যার সমাধানে সহিহ ফতোয়া প্রদানের যোগ্যতাসম্পন্ন করে মুফতি সনদ প্রদান করা হয়।
৫. আদব বিভাগ বা ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স : এ বিভাগে একজন শিক্ষার্থীকে আরবি ভাষায় পরিপূর্ণ যোগ্য করে তোলা হয় যেন দেশে-বিদেশে অনায়াসে দীনের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারে।
জামিয়ার অন্যান্য কার্যক্রম
১. দাওয়াহ ও গবেষণা বিভাগ : দ্বীন প্রচারের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন দাওয়াতি ও গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রতিমাসে এলাকার তাবলিগি সাথীদের সঙ্গে নিয়ে একটি জামাত বের হয় । যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন মসজিদে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করে আসছে।
২. ছাত্র পাঠাগার : সিলেবাসভুক্ত পাঠ্য বইয়ের জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী জ্ঞান-বিজ্ঞান, পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী সমৃদ্ধ একটি ছাত্র পাঠাগারের ব্যবস্থা রয়েছে। যার মাধ্যমে জামিয়ার তালিবে ইলমরা সিলেবাসের বাইরে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ। ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদির জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
৩. পাক্ষিক দেয়াল পত্রিকা : তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে ছাত্রদেরকে লিখনীর ময়দানে দক্ষ করে তুলতে ছাত্রদের লেখাসমৃদ্ধ জামিয়া দুটি পাক্ষিক দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। একটি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় 'আল-ইসলাহ' নামে । অপরটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ভাষা আরবিতে 'আল-ইসলাহ' নামে। এ পত্রিকা দুটি ছাত্রদেরকে দক্ষ লেখকরূপে গড়ে তুলতে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলছে
৪. সাপ্তাহিক বক্তৃতা প্রশিক্ষণ : লিখনীর পাশাপাশি দীনের দাওয়াত ও তাবলিগের কর্তব্য পালনের আবশ্যকতাকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের বাকশক্তি বিকাশের জন্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে প্রতি বৃহস্পতিবার তিবার বক্তৃতা প্রশিক্ষণ মজলিস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে নির্বাচিত বক্তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়।
৫. তরবিয়াতী মজলিস : ছাত্রদেরকে শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নৈতিকভাবে দীক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রতি মাসে অন্তত দুইবার তরবিয়াতী মজলিস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যাতে দেশের বরেণ্য বুযুর্গ ও প্রথিতযশা আলেম-উলামা ইসলাহি বয়ান পেশ করে থাকেন। এ পর্যন্ত জামিয়া এ উপলক্ষ্যে দেশি 3 আন্তর্জাতিক অসংখ্য বরেণ্য বুযুর্গদের পদচারণায় ধন্য হয়েছে।
৬. ফতোয়া ও ফারায়েজ বিভাগ : ইসলামি জীবন যাপনে দেশের জনসাধারণ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনসহ আরো অন্যান্য সমস্যার সমাধাকল্পে যে মাসআলা-মাসায়িল জানতে আলেম-উলামাদের শরণাপন্ন হন, জামিয়ার। অত্র বিভাগ থেকে গ থেকে বিজ্ঞ মুফতি বোর্ডের মাধ্যমে সে সকল বিষয়াদির লিখিত ও ও মৌখিক ফতোয়া প্রদানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
৭. কুতুবখানা বা বা লাইব্রেরি : কুরআন, , হাদিস, তাফসির, ফিকহ, ফতোয়া, উসুল, আকাঈদ, ইতিহাস, আরবি, ব্যাকরণ, সাহিত্য তথা উলুমে ইসলামিয়ার সকল শাস্ত্র ও বাংলা ভাষার সহস্রাধিক বইপত্র সমৃদ্ধ একটি বৃহদাকারের লাইব্রেরী রয়েছে। যা থেকে তালিবে ইলম ও জামিয়ার আসাতিযায়ে কেরাম সর্বদা জ্ঞানের অমিয় সুধা পানে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন।
৮. ডিজিটাল লাইব্রেরি : জামিয়ার কম্পিউটার বিভাগের আওতায় একটি ডিজিটাল ইলেকট্রিক লাইব্রেরির ব্যবস্থাও রয়েছে। যার মাধ্যমে শত-সহস্র ভলিউম থেকে মুহূর্তেই যে কোন তথ্য ও রেফারেন্স উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে বিভিন্ন মাদরাসায় “এ ডিজিটাল লাইব্রেরি সম্প্রসারণের জন্যও এ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে এবং উপযুক্ত ছাত্রদের ইসলামি তথ্য-প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে। [ দেওয়ার জন্য জন্য এ বিভাগ থেকে। থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।
৯. লিল্লাহ বোর্ডিং : সমাজের হতদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে ইলমে নববী অন্বেষণে উঠে আসা তালিবে ইলমরাও যাতে বঞ্চিত না হয় সে সে দিকে লক্ষ্য করেই এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যার ব্যয় সমাজের বিত্তবান ও সুহৃদ ভাই-বোনদের প্রদত্ত যাকাত ফিতরা, মান্নত, কুরবানির চামড়া ও সাধারণ দান ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে।
১০. আবনা ও ফুযালা সম্মেলন : দিলুরোড মাদরাসার ফারেগীন শিক্ষার্থীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতি বছর 'আবনা ও ফুযালা সম্মেলন'-এর আয়োজন করা হয়। এতে জামিয়ার সাবেক ছাত্ররা উপস্থিত হন। দেশের উল্লেখযোগ্য আলেম ও জামিয়ার সিনিয়র উস্তাদরা এতে গুরুত্বপূর্ণ নসিহতমূলক বক্তৃতা পেশ করেন। চলতি বছর ৪ অক্টোবর শনিবার সকাল ৯টা থেকে আসর পর্যন্ত এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুফতি আব্দুস সালাম, মাওলানা যিকরুল্লাহ খান, মাওলানা হাসান জামিল ও মুফতি সালাহ উদ্দিন প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। আগামী বছর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৬ শনিবার "আবনা ও ফুযালা সম্মেলন' অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষার মান ও ফলাফল
শিক্ষার মানে দিলুরোড মাদরাসার সুনাম আজ সর্বজনবিদিত। প্রতি বছর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ [বেফাক)-এর পরীক্ষায় এই মাদরাসা শতাধিক স্টার মার্ক অর্জন করে। এর পাশাপাশি, আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায়ও এ প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে।
২০১৯ ও ২০২২ সালের হাইয়া পরীক্ষায় দিলুরোড মাদরাসার শিক্ষার্থীরা প্রথম দশের মধ্যে স্থান অর্জন করে সারা দেশে আলোচিত হয়। শিক্ষকবৃন্দের নিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম ও আল্লাহর রহমতে এই ধারাবাহিক সাফল্য অব্যাহত রয়েছে।
শিক্ষকমণ্ডলী ও নেতৃত্ব
দিলুরোড মাদরাসার শক্তি হলো এর যোগ্য ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকমণ্ডলী । প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও শায়খুল হাদিস মুফতি সালাহ উদ্দিন শুধু একজন মুহতামি নন; বরং একজন অভিভাবক, দরদি রাহবার ও প্রেরণাদায়ী নেতা। তাঁর বিনয়, দূরদৃষ্টি ও শিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা মাদরাসার প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমান শায়খুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম আদীব, মাওলানা যিকরুল্লাহ খান ও মাওলানা হাসান জামিল এবং শিক্ষাসচিব মুফতি আবু বকর সুহাইল শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ও আদর্শ জীবনের দিশা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের দরসে বসে শিক্ষার্থীরা শুধু জ্ঞানই অর্জন করছে না; বরং শিখছে কীভাবে জীবনকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোয় সাজাতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বিভাগে আছেন বহু অভিজ্ঞ শিক্ষক- কেউ হিফজে পারদর্শী, কেউ ফিকহে, কেউ বা তাফসির ও সাহিত্যচর্চায় বিশেষজ্ঞ।
পাঠদানের পদ্ধতি
দিলুরোড মাদরাসায় পাঠদানের ধরণ ঐতিহ্যবাহী হলেও তাতে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখানে শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়; বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও গবেষণায় উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষকরা ক্লাসে উন্মুক্ত আলোচনা, প্রশ্নোত্তর ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাঠদান করেন। আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য দৈনিক বক্তৃতা অনুশীলন, রচনা প্রতিযোগিতা ও সাহিত্যিক সভা আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা কেবল একজন আলেম নয়, একজন আত্মবিশ্বাসী ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে গড়ে ওঠে।
শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ
দিলুরোড মাদরাসার বিশেষত্ব হলো এর শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশ। নামাজ জামাতে আদায়, সময়মতো ক্লাসে উপস্থিতি, পোশাকে শালীনতা ও আচরণে বিনয়-এসব বিষয় কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। আধ্যাত্মিক চর্চার জন্য নিয়মিত হয় ওয়াজ-নসিহত, জিকির, দোয়া ও তাহাজ্জুদ মাহফিল । শিক্ষার্থীদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মনিবেদনের এই পরিবেশ তাদের মনকে করে পবিত্র, হৃদয়কে করে আলোকিত।
আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির সংযোগ
যদিও এটি একটি কওমি মাদরাসা, তবু সময়ের প্রয়োজনে এখানে আধুনিক শিক্ষার কিছু মৌলিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইংরেজি, বাংলা, গণিত, কম্পিউটার ও সাধারণ জ্ঞানের মৌলিক পাঠ ছাত্রদের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম
দিলুরোড মাদরাসা সমাজের প্রতিও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে। প্রতিবছর রমজানে ইফতার বিতরণ, ঈদে দরিদ্রদের মাঝে পোশাক প্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ- এসব কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পরিচালিত হয়। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে মানবিকতা, সহানুভূতি ও দানশীলতার গুণাবলি বিকশিত হয়।
আমার গর্ব আমি দিলুরোডের ফারেগ
আমি নিজে এই মাদরাসার একজন শিক্ষার্থী এবং প্রথম বর্ষের ফারেগ [দাওরায়ে হাদিস পাস করা ছাত্র] হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। দিলুরোড মাদরাসায় কাটানো সময় আমার জীবনের সবচেয়ে শিক্ষণীয় অধ্যায়।
এখানকার প্রতিটি ক্লাস, প্রতিটি দরস, প্রতিটি নামাজ, এমনকি প্রতিটি সৎ পরামর্শ আমাকে গড়ে তুলেছে ভেতর থেকে । আমি দেখেছি- কীভাবে শিক্ষকেরা ছাত্রদের শুধু পাঠ্যবই নয়, জীবনবোধ শেখান; কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র শিক্ষার জায়গা নয়; বরং আত্মিক প্রশান্তির আশ্রয় হয়ে ওঠে। যখনই শুনি- 'বেফাকের মেধা তালিকায় আবারও দিলুরোড মাদরাসা'- তখন বুক ভরে ওঠে আনন্দে । কারণ, আমি সেই প্রতিষ্ঠানটির সন্তান, যার নাম এখন দেশের সেরাদের মধ্যে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও স্বপ্ন
দিলুরোড মাদরাসার পরিচালনা পর্যদের লক্ষ্য, এটিকে এক আন্তর্জাতিক মানের ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। প্রতিটি জেলায় একটি করে শাখা প্রতিষ্ঠান চালু করা । ভবিষ্যতে এখানে চালু হবে- গবেষণামূলক ইসলামি স্টাডিজ বিভাগ, অনলাইন দাওরা প্রোগ্রাম, আরবি সাহিত্য ও অনুবাদ ইনস্টিটিউট এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিনিময় প্রকল্প এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে মাদরাসাটি শুধু বাংলাদেশের নয়; বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কওমি শিক্ষার এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠবে, ইনশাআল্লাহ ।
ঐতিহ্য, আদর্শ ও দীপ্ত ইতিহাস
অতীতের নিষ্ঠা, বর্তমানের সাফল্য ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন- সবকিছু মিলিয়ে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম [দিলুরোর্ড মাদরাসা] আজ বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার এক অনন্য নাম। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মুফতি সালাহ উদ্দিনের চিন্তাশীল নেতৃত্ব, প্রথম শায়খুল হাদিস মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী ও মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ-এর দোয়া ও দিকনির্দেশনা, বর্তমান শায়খুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম আদীব, মাওলানা যিকরুল্লাহ খান ও মাওলানা হাসান জামিল-এর মেহনত এবং ছাত্রদের নিষ্ঠা- সব মিলেই আজ এটি দেশের সেরা মাদরাসাগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ইট, প্রতিটি দরস, প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন দীন, জ্ঞান ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে।
আমি গর্বিত- কারণ আমি সেই মাদরাসার একজন ফারেগ, যে মাদরাসার নাম এখন দেশের সেরাদের কাতারে। জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম [দিলুরোড মাদরাসা – এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়; বরং এটি এক ঐতিহ্য, এক আদর্শ, এক দীপ্ত ইতিহাস।
লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা গাজীপুর
আইএইচ/

