শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাব ৫
কওমি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হোক পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
লাবীব আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯
আমি আশির দশকে কওমী মাদরাসায় পড়ালেখা করেছি। সে সময় কুরআন, হাদিস, ফিকহ্ পড়ার পাশাপাশি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় রচিত কিতাবও পড়ানো হত। তখন উর্দু বা ফার্সি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে বিষয়বস্তু বোঝানো হতো। সময়ের পরিবর্তনে এখন উর্দু-ফার্সির ব্যবহার সীমিত; অনেক স্থানে সরাসরি বাংলা বা আরবিতেই পাঠদান করা হয়। আরবীতে দক্ষতা অপরিহার্য—ভাষাগত দখল না থাকলে ভালো আলেম হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষাজীবনে মাদরাসায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামল। দেশজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, হরতাল-ধর্মঘট হচ্ছিল, কিন্তু আমাদের দরস নিয়মিত হতো। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার অনুমতি ছিল না। তখন ইসলামী রাজনীতি বলতে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কথাই শুনতাম। পরে খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট ইত্যাদি সংগঠনের আবির্ভাব হয়। জামায়াতে ইসলামীর উপস্থিতি থাকলেও কওমী মাদরাসায় তাদের তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল—আকীদাগত ও আদর্শিক পার্থক্যের কারণে। জামায়াত বা শিবিরে জড়িত থাকলে ছাত্রদের বহিষ্কার করা হতো। তবে আমাদের একজন স্যার জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; তিনি বাংলা পড়াতেন। বাকি উস্তাযগণ ছিলেন জামায়াতের তীব্র বিরোধী। যেহেতু মাদরাসায় রাজনীতি চর্চা ছিল না, তাই সে বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই। এখন পরিস্থিতি অন্যরকম।
দুই
অনেকে মনে করেন, ইসলামে রাষ্ট্র বা রাজনীতি বলে কিছু নেই। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা—প্রাচ্যবাদী প্রতারণা কিংবা মূর্খতার ফল। কুরআনে যাকাতের বিধান রয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অন্যতম উৎস। জিহাদ, গনীমত ও ফাই-এর বিধান রাষ্ট্রীয় কাঠামো সাপেক্ষ। হযরত দাউদ ও সুলাইমান (আ.)-এর বর্ণনা রাষ্ট্র পরিচালনারই দৃষ্টান্ত। পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত নির্দেশনাও কুরআনে বিদ্যমান। মদীনা সনদ একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। নবীজী (সা.) মদীনায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন—ভূমি, সংবিধান ও জনগণ নিয়ে গঠিত ছিল সে রাষ্ট্র। খুলাফায়ে রাশেদীন ও উমর বিন আবদুল আজীজ (রহ.) ন্যায়ভিত্তিক শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন এবং বহু অঞ্চল জয় করেছেন। সুতরাং, ইসলামে রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই—এ দাবি অমূলক।
তিন
কওমী মাদরাসা দারুল আরকাম ও আসহাবে সুফফার ধারাবাহিকতা। সুফফার ছাত্র হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ও মুআয ইবনে জাবাল (রা.) গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নবীজী (সা.) মসজিদে নববীতে আদালত পরিচালনা করেছেন, বিশ্বনেতাদের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন। হাদীসের কিতাবসমূহে ‘কিতাবুল উমারা ওয়াল ক্বাদা’ অধ্যায় রাষ্ট্র ও প্রশাসন বিষয়ক ইসলামী নির্দেশনার স্বাক্ষর।
উপমহাদেশে ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’ এবং তুরস্কে ‘আহকামুস সুলতানিয়া’ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার রূপরেখা প্রদান করে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে মাওলানা মানাযির আহসান গিলানীর গবেষণাগ্রন্থ প্রণিধানযোগ্য। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বাগদাদের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এসবই রাষ্ট্র ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিষয়। ইসলামে রাষ্ট্র, সরকার বা রাজনীতি নেই—এ কথা হয় অজ্ঞতার কারণে বলে, নয়তো ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা অস্বীকারের জন্য বলে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার দিকও সন্নিবেশিত। তবে ইসলাম মানেই শুধু রাজনীতি নয়। বর্তমানে কিছু মহল ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ আখ্যা দিয়ে ইসলাম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়—এটি একটি ধাপ্পাবাজি।
চার
যেহেতু ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং কুরআন-হাদীসে এ সংক্রান্ত স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে, তাই এ বিষয়ে পঠন-পাঠন জরুরি। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা রাষ্ট্রপ্রশাসন নিয়ে পড়ানো হলেও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা থাকে না। অন্যদিকে, কওমী মাদরাসার সিলেবাসেও এ বিষয়ে পৃথক কোনো বই বা কোর্স অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রচিত ‘ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, কিন্তু তা কওমী সিলেবাসে স্থান পায়নি। তিনি ইসলামী অর্থনীতি নিয়েও লিখেছেন, যা আগে ফযীলত পর্যায়ে পড়ানো হলেও পরে বেফাক বাতিল করেছে।
প্রস্তাবনা
কওমী মাদরাসার উচ্চস্তর—যেমন ফযীলত, তাখাসসুস ফিল হাদীস বা ইফতা কোর্সে—পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হোক। প্রয়োজনীয় বইপত্র নির্ধারণ করে মুহাদারা ও বিশেষ আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে। দাওরায়ে হাদীস শেষে একবছরের ডিপ্লোমা কোর্সও চালু করা যেতে পারে এ বিষয়ে। এর মাধ্যমে ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও আধুনিক রাষ্ট্রপ্রশাসন সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন সম্ভব হবে। ফিকহের অনেক বিষয়—যেমন হদ, কিসাস, মুসলিম পার্সোনাল ল—সরাসরি রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত।
কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি যাই হোক, আমাদের সিলেবাসে যুগোপযোগী সংস্কার, প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন অব্যাহত রাখা দরকার।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহ

