কুরআনি মক্তবের গুরুত্ব ও দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা
মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৫
বর্তমান যুগে মুসলিম উম্মাহর নতুন প্রজন্মের আকীদা (বিশ্বাস), মুয়ামালাত (লেনদেন), মুআশারাত (সামাজিকতা), চিন্তা ও চেতনার ওপর প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেভাবে চারদিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে এবং যার ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষ, শিক্ষিত শ্রেণী, শিশু ও যুবকদের মধ্যে চিন্তাগত ভ্রষ্টতা ও সামাজিক ধর্মত্যাগের ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক প্রভাব প্রতিদিন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাতে কুরআনি মক্তবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যে কত বেড়ে গেছে, তা কারও কাছে গোপন নয়। এই হতাশাব্যঞ্জক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে, স্বনির্ভর ও সুসংগঠিত মক্তব ব্যবস্থা হলো সেই একমাত্র আলোকবর্তিকা, যার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উম্মাহর নিষ্পাপ শিশুদের ঈমান ও ইসলামের সুরক্ষা করা যেতে পারে এবং বাতিলের বিষের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে কাজ নেওয়া যেতে পারে। এ কারণেই উম্মাহর বিশিষ্টজনেরা তাঁদের প্রজ্ঞার আলোকে দিয়ে বহু বছর আগেই তাদের লেখনি ও আলোচনার মাধ্যমে কুরাআনি মক্তবের গুরুত্ব ও উপকারিতা বোঝানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
আকাবিরদের মূল্যবান বাণী
মাওলানা আবুল হাসান আলি নদবি (রহ.) বলেন: ‘আজ সবচেয়ে বেশি যে জিনিসের প্রয়োজন এবং যা সমস্ত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারে, তা হলো আমাদের এই সিদ্ধান্ত যে, আমরা আমাদের সন্তানদের দীনি শিক্ষাকে অন্য সকল শিক্ষার ওপর প্রাধান্য দেবো।’ বাচ্চাদের ঈদের কাপড় তৈরি করা এবং অসুস্থ হলে ভালো চিকিৎসা করার চেয়েও বেশি জরুরি হলো, তাদেরকে খাঁটি ও পাকা মুসলমান বানানো। যে মাকতাব একবার প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ভেঙে যাওয়াকে গোনাহ মনে করো।’
হযরত মাওলানা মানযুর নুমানী (রহ.) বলেছেন: ‘মুসলমানরা দুটি বিষয়ের মধ্যে যেকোনো একটিতে রাজি হয়ে যান: হয় নিজেদের সন্তানদের দীনি ও সাংস্কৃতিক ধর্মত্যাগের ওপর, নয়তো এই পথে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ করার ওপর।’
হযরত শাইখুল হিন্দ (রহ.) বলেছেন: ‘মাল্টার জেল থেকে মুসলমানদের পতন দূর করার জন্য আমি দুটি সংকল্প নিয়ে এসেছি: এক : তরুণদের কুরআনের কাছাকাছি আনার জন্য মসজিদে দরসে কোরআনের ব্যবস্থা করা হোক। দুই : বাচ্চাদের জন্য গ্রামে গ্রামে মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হোক।’
হযরত থানবি (রহ.) বলেছেন: ‘সর্ব প্রথম মুসলমানের বাচ্চাকে কুরআন পড়ানো হোক।’
হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহ.) বলেছেন: ‘আমি একশটি মক্তবের খরচ একা বহন করতে প্রস্তুত।’
কবি ইকবাল (রহ.) বলেছেন: ‘এই মাদ্রাসা ও মক্তবগুলোকে এই অবস্থাতেই থাকতে দাও। যদি এগুলো না থাকে, তবে এই দেশের মুসলমানদের যে অবস্থা হবে, তা আমি স্পেনে নিজ চোখে দেখে এসেছি।’
মসজিদ ও মাদ্রাসার দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা
আকাবিরদের উপরিউক্ত মূল্যবান দিকনির্দেশনা এবং দেশে যথেষ্ট পরিমাণ আদর্শ মক্তব না থাকায় দাবি ছিল যে, মসজিদ ও মক্তবের দায়িত্বশীলরা উম্মাহর নিষ্পাপ শিশুদের মদ, জুয়া, লটারি, সিনেমা দেখা, নগ্নতা, নির্লজ্জতা, ভোগ-বিলাস ও উচ্ছৃঙ্খলতার বন্যায় ডুবে যেতে দেখে উদ্বিগ্ন হবেন। তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে, আলেম ও ইমামদের সহযোগিতা ও সম্মানের সাথে, উম্মাহর শিশুদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের এমন এক সুরক্ষিত, সুসংহত ও সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন, যার বদৌলতে শত শত বছর ধরে আগত প্রজন্মের ঈমান ও ইসলামের হেফাজতের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কিন্তু! দুঃখের বিষয়, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। মসজিদ ও মক্তবের দায়িত্বশীলদের অধিকাংশই এমন ব্যক্তি, যারা দীনি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। ইলম ও আলেমের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সদাচার ও খোদাভীরুতা থেকে দূরে। আমানত ও সততায় ত্রুটিপূর্ণ। পাপাচারে আসক্ত। অপচয়ে অভ্যস্ত এবং মক্তবের প্রয়োজন, গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে বেখবর। তাদের চিন্তা-ভাবনার পরিধি কেবল বেশি বেশি চাঁদা তোলা, মসজিদের দেয়াল, মিম্বর ও মেহরাবের সজ্জা এবং আলি-শান, উঁচু মিনার নির্মাণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
ভয়াবহ ক্ষতিসমূহ
মসজিদ ও মক্তবের এই মহান পদে অযোগ্য ব্যক্তিদের থাকার কারণে উম্মাহ তিনটি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এক : আলেমদের অপচয়: হাজার হাজার যোগ্য, প্রতিভাবান আলেম-ইমাম, যারা একই সাথে একাধিক ক্ষেত্রে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক; এই তিন লাইনেই উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়ার উচ্চ দক্ষতা রাখেন, নিজেদের জ্ঞান ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে আরবি প্রথম বর্ষ থেকে বুখারী পর্যন্ত মাদ্রাসা পরিচালনা করতে পারেন, তাঁদের সহজাত দা’ঈসুলভ প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে জায়গায় জায়গায় দ্বীনি ও নুরানী পরিবেশে ভরিয়ে দিতে পারেন। পতিত এলাকাগুলোকে মক্তবের সুন্দর ব্যবস্থা দিয়ে আবাদ করতে পারেন, তাঁরা কেবল মিম্বর-মেহরাব এবং গতানুগতিক মক্তবি কর্ম নিয়েই থেকে যাচ্ছেন।
দুই : শিশুদের প্রতিভা নষ্ট: উচ্চ প্রতিভা ও সম্ভাবনায় পূর্ণ উম্মাহর লক্ষ লক্ষ শিশু। যারা উম্মাহর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত উপহার। যাদেরকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে তারা দ্বীনি ব্যক্তিত্বে বিকশিত হয়ে উম্মাহকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞান, লাঞ্ছনা থেকে সম্মান, দারিদ্র্য থেকে প্রাচুর্য, গোলামি থেকে শাসন এবং পতন থেকে উত্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারত। তারা মাকতাবের মান্ধাতা আমলের, বর্ণহীন ও প্রাণহীন ব্যবস্থার কারণে নষ্ট হয়ে সমাজে জুয়া, লটারি, নেশা, উচ্ছৃঙ্খলতা, অশ্লীলতা ও নগ্নতা ছড়িয়ে বাতিলের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
তিন : অবকাঠামোর অপব্যবহার: শত শত মসজিদ ও মক্তবের ভবন, যেখানে দীনি জ্ঞান একাধিক স্তরে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। যেখানে একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থার অধীনে হাজার হাজার ছেলে-মেয়েকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা যেতে পারে। তা কেবল কয়েকটি শিশুকে নিয়ে দায়সারা গোছের শিক্ষা দিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে।
তিনটি পরীক্ষিত-সহজ সমাধান
রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদীসের আলোকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো: সমস্ত মসজিদ ও মাকতাবের দায়িত্বশীলরা আল্লাহকে ভয় করুন। নিজেদের পদবীগুলোকে পদের বদলে দায়িত্ব মনে করুন। মসজিদ ও মাকতাবের দায়িত্বশীল হওয়ার শর্ত ও গুণাবলী নিজেদের মধ্যে তৈরি করুন এবং যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তাতে অহেতুক হস্তক্ষেপ না করুন।
এক. মক্তবের কাজ সম্পূর্ণভাবে আলেম ও ইমামদের হাতে ছেড়ে দিন। মাকতাবের বিশেষজ্ঞরা আলেমদের তত্ত্বাবধানে মক্তবের উন্নতি সাধন করুন। শিক্ষকতার জন্য সস্তা, ত্রুটিপূর্ণ ও অলস কর্মীদের পরিবর্তে দরদী, বিশেষজ্ঞ ও পরিশ্রমী শিক্ষকদের নির্বাচন করুন, এমনকি এর জন্য যত অতিরিক্ত খরচই বহন করতে হোক না কেন। মনে রাখবেন! সস্তা, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ করা, মক্তব ও প্রজন্মকে বরবাদ করার ওপর রাজি হওয়া এবং পুরো জাতিকে ধোঁকা দেওয়া।
দুই. শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও মক্তবের ব্যবস্থায় উন্নতির মানসিকতা তৈরি করুন। উন্নত মানসিকতার দুর্ভাগ্যই আমাদের মক্তবগুলোকে সময়ের গতি, মানুষের মেজাজ ও শিশুদের মনস্তত্ত্ব থেকে অনেক পিছনে ঠেলে দিয়ে অকার্যকর করে দিয়েছে।
মক্তবের দায়িত্বশীলরা এর জন্য নিজেদের মূল্যবান সময় বের করে উন্নত, সক্রিয় ও সুসংগঠিত করে মক্তবগুলো গড়ে তুলুন। শিক্ষকদের জন্য প্রতি বছর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন, যাতে শিক্ষা পদ্ধতি, ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমের নতুন নতুন ভালো দিক দিয়ে নিজেদের মাকতাবকে সজ্জিত করে উম্মাহর জন্য বেশি বেশি উপকারী বানানো যায়। এলাকাভিত্তিক/উপজেলাভিত্তিক চিন্তাশীল আলেম ও ইমামদের নিয়ে একটি ‘মাকতাব বোর্ড’ গঠন করুন। এই বোর্ড এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাপ্তাহিক/মাসিক পরামর্শ করুক এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী নতুন মক্তব স্থাপন ও পুরনো মক্তব উন্নতির চিন্তা করুক।
মনে রাখবেন, মক্তব হলো একটি ৪ চাকার গাড়ি: (১) ব্যবস্থা (নিযাম), (২) পাঠ্যক্রম (নিসাব), (৩) শিক্ষা পদ্ধতি (তারীকা-এ-তালীম), (৪) তত্ত্বাবধান। এর জন্য চারজন হওয়া জরুরি: (১) কমিটি, (২) শিক্ষক, (৩) শিশু, (৪) অভিভাবক। যদি একটি চাকাও না থাকে, বা একটিতেও হাওয়া না থাকে, তাহলে এই গাড়ি চলতে পারে না। আফসোস! আমাদের শত শত মক্তব চাকা ছাড়াই চলছে এবং কেউ খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। (আল্লাহর কাছেই আমাদের অভিযোগ)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা

