বাংলাদেশে কওমি মাদরাাসা শিক্ষা একটি প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মাদরাাসাগুলো নৈতিকতা, ধর্মীয় জ্ঞান, মানবিকতা ও চরিত্র গঠনে অমূল্য অবদান রেখে আসছে। দাওরায়ে হাদিসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর কওমি শিক্ষার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। তবে বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে, সমাজের প্রয়োজন বিস্তৃত হচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসারিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিও নতুনভাবে ভাবতে হবে। কওমি মাদরাাসার মূল আদর্শ অটুট রেখে কিছু সময়োপযোগী সংস্কার গ্রহণ করা হলে এই শিক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও আধুনিক হয়ে উঠবে বলে আশাবাদী।
পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়ন ও সিলেবাস সংস্কার
কওমি মাদরাাসার পাঠ্যক্রম দারস-এ-নিজামি ভিত্তিক। যা ইসলামি জ্ঞানচর্চার মূলধারা এবং এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ, সমাজে সক্রিয় ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ পেশাগত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে সিলেবাসে কিছু জরুরি সংযোজন প্রয়োজন।
প্রথমত: সাধারণ শিক্ষার মৌলিক বিষয়। যেমন- গণিত, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্যপ্রযুক্তি যোগ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ, হিসাব-নিকাশ, লেখা-পড়া, অনলাইন ব্যবস্থাপনা- এসব দক্ষতা ছাড়া দৈনন্দিন জীবন ও কর্মজীবনে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত: তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান যুক্ত করা সময়ের দাবি। কম্পিউটার ব্যবহার, ইন্টারনেট রিসার্চ, ই-মেইল, ডকুমেন্ট তৈরি, ডিজিটাল লাইব্রেরি- এসব দক্ষতা কওমি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চাকে বৈশ্বিক পরিসরে নিয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত: বাস্তবমুখী আরবি ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধিতে আরও জোর দিতে হবে। শুধু গ্রামার ও কিতাব পড়া নয়; সাবলীল আরবি বলায়, লেখায় এবং যোগাযোগে দক্ষতা বাড়াতে সিলেবাসে ভাষা প্রশিক্ষণ, বক্তৃতা অনুশীলন ও লেখালেখির কার্যক্রম যুক্ত করা জরুরি।
চতুর্থত: গবেষণামুখী ও সমালোচনামূলক চিন্তা গড়ে তুলতে বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন, গবেষণা অ্যাসাইনমেন্ট ও তুলনামূলক ফিকহ পাঠ যুক্ত করা যেতে পারে।
সবশেষে সমাজ-জ্ঞান, নাগরিক শিক্ষা, সমকালীন বিষয়াবলি সম্পর্কে ধারণা যুক্ত করা। শিক্ষার্থীদের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। সিলেবাস সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হলো- ধর্মীয় মূল শক্তিকে বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের আধুনিক, কর্মক্ষম ও বহুমুখী জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলা।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় শক্তি তার শিক্ষকগণ। অনেক কওমি শিক্ষক নিষ্ঠা ও ত্যাগের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তবে আধুনিক শিক্ষণ-পদ্ধতি, ক্লাস ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষার্থীর মানসিক প্রয়োজন, আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। মাদরাসাভিত্তিক টিচার্স ডেভেলপমেন্ট সেল, নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও কর্মশালা আয়োজন শিক্ষার মানকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে।
শিক্ষকদের ডিউটি টাইম ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ
কওমি মাদরাাসায় শিক্ষকদের দায়িত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত- ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার কাজ, শিক্ষার্থীদের পরামর্শ, মসজিদের দায়িত্ব, প্রশাসনিক কাজ- সব মিলিয়ে সময় ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে যায়। ফলে অনেক শিক্ষক অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন এবং স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার মানেও প্রভাব পড়ে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় শিক্ষকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি টাইম নির্ধারণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস কার্যকর হলে কাজগুলো সময়মতো সম্পন্ন হবে। শিক্ষকরা মনোযোগী, বিশ্রামপ্রাপ্ত ও শক্তিশালী মানসিক অবস্থায় পাঠদান করতে পারবেন। মাদরাসার প্রশাসনিক কাজ সুসংগঠিত হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য “অফিস আওয়ার” চালু করা যাবে, যেখানে তারা সমস্যার সমাধান, পরামর্শ ও অতিরিক্ত শিক্ষা পাবে। শিক্ষকরা পরিবার ও ব্যক্তিজীবনে সময় দিয়ে মানসিকভাবে আরও সুস্থ থাকবেন। সার্বিকভাবে ৮ ঘণ্টা ডিউটি সিস্টেম কওমি মাদরাসায় দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি ও পেশাদারিত্ব আরও বাড়াবে।
আর্থিক স্বচ্ছতা ও সুশাসন কওমি মাদরাসা জনগণের দান-সদকা, জাকাত ও ওয়াকফ তহবিল দিয়ে পরিচালিত হয়। এই কারণে আর্থিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত অপরিহার্য। নিয়মিত অডিট, হিসাব প্রকাশ, তহবিলের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক জবাবদিহি; এসব ব্যবস্থা জনগণের আস্থা বাড়াবে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা সহজ হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন বহু মাদরাসার ক্লাসরুম, হোস্টেল, লাইব্রেরি এবং স্বাস্থ্যসুবিধা এখনো অপ্রতুল। সুপরিকল্পিত ভবন, প্রশস্ত ক্লাসরুম, মানসম্মত আবাসিক ভবন, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, আধুনিক স্যানিটেশন, গবেষণা কক্ষ ও কম্পিউটার ল্যাব- এসব অবকাঠামো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি সুস্থ, নিরাপদ ও আধুনিক পরিবেশ শিক্ষার্থীর শেখার ক্ষমতাকে সরাসরি উন্নত করে।
শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি
দাওরায়ে হাদিস শেষে অনেক শিক্ষার্থী পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধায় থাকে। পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, ইসলামিক ব্যাংকিং, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, দাওয়াতি কার্যক্রম, আরবি স্পেশালাইজেশন- এ ধরনের কোর্স যুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে।
গবেষণা সংস্কৃতি বিকাশ
গবেষণা ছাড়া জ্ঞান বিকশিত হয় না। কওমি মাদরাসায় ইসলামি আইন, ইতিহাস, সমাজনীতি, ভাষাশাস্ত্র ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার পরিসর আরও বিস্তৃত করা দরকার। গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, একাডেমিক জার্নাল প্রকাশ ও ডিজিটাল লাইব্রেরি তৈরি শিক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
অনলাইন ক্লাস, ডিজিটাল নোট, শিক্ষার্থীর ডাটাবেইস, অনলাইন ভর্তি ও ফলাফল ব্যবস্থাপনা এসব প্রযুক্তি ব্যবহার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও গতিশীল করবে। প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে আরও সফল হতে পারবে।
কওমি মাদরাসা বাংলাদেশের ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনে অমূল্য অবদান রেখে চলেছে। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজন কিছু বাস্তবধর্মী সংস্কার- সিলেবাস আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিউটি টাইম সংগঠিতকরণ, আর্থিক স্বচ্ছতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণা বিস্তার, প্রযুক্তি ব্যবহার ও জাতীয় পরিসরের সঙ্গে সমন্বয়। এ সংস্কারসমূহ বাস্তবায়িত হলে কওমি মাদরাসা শুধু ঐতিহ্যের ধারকই নয়; বরং আধুনিক, শক্তিশালী এবং বহুমাত্রিক জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে দেশের অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা পটুয়াখালী

