জামিয়া হামিয়ুস সুন্নাহ মেখল মাদরাসা; জ্ঞানের অলৌকিক ঠিকানা
ফয়সাল আহমদ
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৩০
আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছে চট্টগ্রামের প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া হামিয়ুস সুন্নাহ মেখল মাদরাসায়। তারপর হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শৈশবে অনেকের মুখে শুনেছিলাম, মেখল মাদরাসার বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও ইলম পাওয়া যায়। তখন মনে হয়েছিল, এ যেন অতিরঞ্জিত কথা। কিন্তু যখন আমি মেখল হামিয়ুস সুন্নাহ মাদরাসায় ‘জামাতে উর্দু খানায়’ ভর্তি হয়ে মাত্র দুমাসের মতো সময় কাটিয়ে অন্য এক মাদরাসায় চলে যাই; তখন সেখানে গিয়েই টের পেলাম, মেখল মাদরাসার বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও ইলম পাওয়া যায়। এ কথাটা আসলে শুধু কথার কথা নয়, সত্যিকারের বাস্তবতা।
মেখল মাদরাসায় তাকরার না করে যতটুকু জ্ঞান অন্বেষণ করেছি তা অন্য মাদরাসায় তাকরার করে অর্জন করতে হয়েছে। তারপর আবার মেখল মাদরাসায় এসে ‘জামাতে কাফিয়া’ থেকে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া করি। তবে এই কথার দ্বারা আমি কোনো প্রতিষ্ঠানকে ছোট করতে চাই না। প্রত্যেক মাদরাসারই নিজস্ব সৌন্দর্য ও বরকত রয়েছে। ‘জামিয়া হামিয়ুস সুন্নাহ মেখল’ আমাকে শিখিয়েছে কেবল পড়তে নয়; চিনতে- আল্লাহকে, মানুষকে, নিজেকেও। এখানে আমি পেয়েছি এমন এক শিক্ষার পরশ, যা কাগজে মাপে নয়, কিন্তু চরিত্রে গড়ে তোলে মানুষ।
মেখল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা
জামিয়া হামিয়ুস সুন্নাহ মেখল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হলেন মোজাদ্দেদে মিল্লাত মুসলিহে উম্মত মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ রহ.। মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৩১ সালে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হুজুরের বাড়ির মসজিদ-সংলগ্ন পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও জায়গার অভাবের কারণে ১৯৭৮ সালে মাদরাসাটি বর্তমানের মনোরম ও প্রশস্ত স্থানে স্থানান্তর করা হয়।
অবস্থান
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত মেখল ইউনিয়নের পূর্ব মেখল গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাটি।
বর্তমানে মেখল মাদরাসার পরিচালকের দায়িত্বে আছেন আল্লামা উসমান ফয়জী দা.বা.। শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মাওলানা নাসির উদ্দীন দা.বা.। সহকারী শিক্ষা পরিচালক হলেন মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়জী দা.বা.। নাজেমে দারুল ইকামা হলেন, মাওলানা ইসমাইল খান দা.বা.। আর সহকারী নাজেমে দারুল ইকামা মাওলানা মাহমুদ হাসান ফয়জী দা.বা.।
শিক্ষাস্তর
প্রথমত নুরানি বিভাগ। এতে প্লে থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস রয়েছে। আর কিতাব বিভাগে পাঠদান শুরু হয় জামাতে উর্দুখানা থেকে। অতঃপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে পৌঁছে জামাতে হেদায়া পর্যন্ত। পাশাপাশি রয়েছে কেরাত বিভাগ ও হস্তলিপি বিভাগ। যেখানে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মনোমুগ্ধকর তাজবিদের ধ্বনি ও নান্দনিক লেখনীর সৌন্দর্যে দক্ষ করে তোলা হয়।
জামিয়ার শুরু থেকে পরিচালকগণের নাম
১. মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ রহ.। পরিচালনাকাল ১৯৩১ থেকে ১৯৭৬ সাল।
২. বাকিয়াতুছ ছলফ হজরত আলহাজ শাহ মোজাফফর আহমদ রহ. (প্রকাশ মেঝ হুজুর)। পরিচালনাকাল ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল।
৩. তারজুমানে আহলুচ্ছুন্নাহ আল্লামা নোমান ফয়জী রহ.। পরিচালনাকাল ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল।
৪. আল্লামা উসমান ফয়জী দা.বা.। পরিচালনাকাল ২০২১ থেকে বর্তমান।
জামিয়ার শীর্ষস্থানীয় উস্তাদ যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন
১. হজরত আল্লামা আজিজুল্লাহ রহ.। নোয়াখালী (যিনি বড় হুজুর নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন)।
২. হজরত আল্লামা মোজাফফর আহমদ রহ. (মেঝ হুজুর)।
৩. হজরত আল্লামা মুফতি সাইফুল ইসলাম হাতিয়ুবী রহ.
৪. হজরত আল্লামা ইউসুফ রহ. গড়দুয়ারী।
৫. হজরত আল্লামা হাফেজ আজিজ আহমদ রহ. মেখলী (প্রকাশ হাফেজ সাহেব হুজুর)
৬. হজরত মাওলানা আব্দুর রহিম রহ. (প্রকাশ গহিরা হুজুর)
৭. হজরত মাওলানা মুফতি ইব্রাহিম খান রহ.(প্রকাশ খান সাহেব হুজুর)
৮. হজরত মাওলানা ফুরকান ফয়জী রহ.।
৯. আল্লামা মুফতি সাইফুল ইসলাম সন্দীপী রহ.।
আয়ের উৎস: ছাত্রদের ভর্তি ফি, বার্ষিক পরীক্ষার ফি, মাদরাসার মাছ ও ফল বিক্রি এবং মাদরাসায় এসে জনগণের স্বেচ্ছায় দেওয়া চাঁদা ও দান-সদকা।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য : এই জামিয়া কোনো প্রকার চাঁদা সংগ্রহে বাইরে যায় না। ধান, চাউল, চামড়া বা অন্যান্য জিনিসপত্র কালেকশন করা হয় না। তবে যারা চাঁদা বা জাকাত-সদকা দিতে চান, তারা মাদরাসায় এসে নিজ উদ্যোগে দিয়ে যান। জাকাত এবং ছদকার টাকাগুলো প্রতি মাসে গরিব ছাত্রকে তাদের খোরাকি বাবদ নগদ টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। তারা তা দিয়ে নিজে রান্না করে খায়।
জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতার কঠোর নির্দেশনার কারণে এক ফান্ডের অর্থ অন্য ফান্ডে ব্যয় করা হয় না। ফলে অর্থের ব্যবহার সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত থাকে।
অধ্যয়নরত : হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

