বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। এটি আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার অন্যতম শক্ত ভিত্তি। বহু প্রজন্ম ধরে এখানে দ্বীনি জ্ঞান, নৈতিকতা, চরিত্র গঠন এবং ঈমানের মূলনীতিগুলো ধারণ হয়ে এসেছে। দেশের বিস্তীর্ণ জনগোষ্ঠী এই ব্যবস্থার ওপর গভীর আস্থা রাখে। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে কওমি মাদরাসার সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। গ্রাম থেকে শহর, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহুরে কেন্দ্র- প্রতিটি স্থানে নতুন মাদরাসা গড়ে উঠেছে। অভিভাবকরাও সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা ও ইসলামি শিক্ষার জন্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশার। তবে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে- মাদরাসার সংখ্যা বাড়লেও কি শিক্ষার গুণগত মান এবং ছাত্রছাত্রীদের দ্বীনি আমলের মান সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে? বিশিষ্ট আলেম, গবেষক এবং শিক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, এই বৃদ্ধির প্রধান ধারা এখনও পরিমাণমুখী আর গুণগত উন্নয়ন পিছিয়ে।
কওমি মাদরাসার মূল পাঠ্যক্রম ‘দারসেনিজামি’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ। একসময় এটি ভারত উপমহাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা, যুক্তি- সব মিলিয়ে এটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা। তবে প্রশ্ন হলো, আজকের সময়ে কি এটি যথাযথভাবে আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে?
আজকের আলেমকে শুধু মাসআলা জানা যথেষ্ট নয়। তাকে হতে হবে সমাজ বিশ্লেষণে দক্ষ, প্রযুক্তি সচেতন, ভাষাগতভাবে পারদর্শী, গণমাধ্যমে নিপুণ, সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণাসম্পন্ন এবং যুক্তিনির্ভর চিন্তায় পারদর্শী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক মাদরাসায় গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি, কম্পিউটার শিক্ষা এবং গবেষণার কৌশল এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা কিতাবের জ্ঞান জানলেও বাস্তব জীবনের সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানে অনেক সময় পিছিয়ে পড়ে।
শিক্ষকের ভূমিকা শিক্ষার মান নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিকাংশ কওমি মাদরাসায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যারা পড়ান, তারা যেভাবে শিখেছেন, সেভাবেই শিক্ষাদান করেন। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে শিশু মনস্তত্ত্ব, পাঠদানের কৌশল, ক্লাস ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখা এবং গবেষণাধর্মী শিক্ষাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব না থাকলে পাঠদান প্রাণবন্ত হয় না, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের দক্ষতা সীমিত থাকে।
কওমি মাদরাসাগুলো সাধারণত স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার সুবিধা থাকলেও বড় সমস্যা হলো- কোনো কেন্দ্রীয় মানদণ্ড বা তদারকি ব্যবস্থা নেই। এক মাদরাসার মান খুব ভালো হতে পারে, অন্যটির মান অনেকটা পিছিয়ে থাকতে পারে। এটি শিক্ষার মানে অসঙ্গতি তৈরি করে। একটি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে ন্যূনতম শিক্ষাগত মান সব মাদরাসায় নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।
প্রশাসনিক ও পরিকল্পনাগত দুর্বলতাও মান উন্নয়নের পথে বড় বাধা। অনেক মাদরাসা ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত হয়। উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বৈজ্ঞানিক ও দূরদর্শীভাবে পরিচালনা করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, লক্ষ্য নির্ধারণ, শিক্ষক দলের নিয়মিত বৈঠক ও যৌথ মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। এই ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিষ্ঠান চললেও শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায় না।
আজকের যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া শিক্ষা অসম্পূর্ণ। শিক্ষার্থীরা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, ডিজিটাল লাইব্রেরি, অনলাইন তথ্যভান্ডার, গবেষণার সফটওয়্যার এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে পরিচিত না হলে বৈশ্বিক জ্ঞানসংগ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার এবং দ্বীনি দাওয়াহ কার্যক্রমকে বহুগুণে সম্প্রসারিত করতে সহায়তা করে।
ছাত্রসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধি এবং শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতের অসমতা শিক্ষার মানে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এক ক্লাসে ৫০–৭০ জন শিক্ষার্থী থাকলে শিক্ষক সবার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারেন না। দুর্বল শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে, মেধাবীরা যথাযথ চ্যালেঞ্জ পায় না। শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয় এবং আমলের পরিবেশও ব্যাহত হয়।
বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগের অভাবও বড় সমস্যা। একজন আলেম কেবল মসজিদের খতিব নন, তিনি সমাজের নেতা, দাওয়াহকর্মী, সমস্যাবিশ্লেষক, বক্তা, লেখক ও গবেষক। কিন্তু বর্তমান পাঠ্যক্রমে যোগাযোগ দক্ষতা, সমাজবিজ্ঞান, দাওয়াহ কৌশল, নেতৃত্ব, বক্তৃতা দেওয়ার দক্ষতা, লেখালেখি ও অনুবাদ বিষয়গুলো পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে অনেক আলেমের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সমাজে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা সীমিত থাকে।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও শিক্ষার মান উন্নয়নের পথে বড় বাধা। কওমি মাদ্রাসার অধিকাংশই দানের ওপর নির্ভরশীল। স্থায়ী আয় না থাকায় দক্ষ শিক্ষক রাখা, লাইব্রেরি ও ল্যাব নির্মাণ, আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছাড়া মানোন্নয়ন কল্পনাও করা যায় না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমলের মানের অবনতি। দ্বীনি শিক্ষা কেবল জ্ঞান নয়, এটি চরিত্র গঠন, নৈতিকতা এবং আত্মশুদ্ধির শিক্ষা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তারবিয়াতের পরিবেশ দুর্বল, শৃঙ্খলা কম, ধারাবাহিকতা নেই, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে আদর্শিক বন্ধন কম। জ্ঞান যদি আমলে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা বরকত হারায়।
মান উন্নয়নের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান হলো- যুগোপযোগী ও ভারসাম্যপূর্ণ পাঠ্যক্রম, বাধ্যতামূলক শিক্ষক প্রশিক্ষণ, কেন্দ্রীয় মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, নৈতিকতা ও আমলের পরিবেশ সুদৃঢ় করা এবং দক্ষতা–মুখী শিক্ষা। এতে শিক্ষার্থীরা কেবল দ্বীনি জ্ঞানেই দক্ষ থাকবে না, বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও প্রস্তুত হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, কওমি মাদরাসা আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূলভিত্তি। এর বিস্তার আনন্দের সংবাদ। কিন্তু স্থায়ী ও কার্যকরী হওয়ার জন্য গুণগত মান বৃদ্ধিই অপরিহার্য। উন্নত পাঠ্যক্রম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, প্রযুক্তি সংযোজন, চরিত্র গঠন এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে কওমি মাদ্রাসা আগামীর বাংলাদেশকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি উপহার দিতে সক্ষম হবে। এতে গড়ে উঠবে দূরদর্শী, জ্ঞানী, চরিত্রবান এবং সমাজের প্রকৃত পথপ্রদর্শক আলেম সমাজ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কওমি শিক্ষাব্যবস্থার অনুরাগী ও ইসলামিক স্টাডিজ গবেষক

