শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা
কওমি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
লাবীব আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৩
তানজিমুল মাদারিস আল কওমিয়া কিশোরগঞ্জ এবং তানজিমুল মাদারিস আদদীনিয়া উত্তরাঞ্চল (বগুড়া জামিল মাদরাসাকেন্দ্রিক) শিক্ষাবোর্ডের দফতর পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। বোর্ডের কর্মকর্তা ও জিম্মাদারদের সাথে আমার দীর্ঘ মতবিনিময় হয়েছে। সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে বোর্ডের বহুমুখী উদ্যোগ ও আয়োজন। তানজিমুল মাদারিস কিশোরগঞ্জ ১৯৮২ সাল থেকে কওমি মাদরাসার শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে। তবে পরীক্ষাকেন্দ্রিক কাজ বেশি। ১৯৯৫ সাল থেকে শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তানজিমুল মাদারিসিল আদদীনিয়া আল কওমিয়া (উত্তরাঞ্চল)।
বোর্ড দুটি ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশের দফতরে একাধিকবার সরেজমিনে গিয়ে কার্যক্রম দেখেছি। কওমি মাদরাসার বোর্ডগুলো ব্যক্তিত্ব, এলাকা এবং মাদরাসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বোর্ডগুলোর মাধ্যমে পড়ালেখার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বোর্ডের ফলাফল ভালো হলেই সেই মাদরাসায় তালেবে ইলমরা ভর্তির প্রতিযোগিতা করে। মেধাবীরা ভীড় করে। যেহেতু টিসি পদ্ধতি নেই, তাই শত শত মাদরাসার মেধাবী ছাত্ররা তাদের মনের মতো মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে। উস্তায রাগ করবেন না খুশি হবেন- তা তাদের দেখার বিষয় নয়। তাদের প্রয়োজন বোর্ডের রেজাল্ট। যদিও এই রেজাল্টের বিশেষ কোনো কার্যকারিতা নেই কর্মজীবনে। ফলাফল ভালোর জন্য নোট-গাইড পড়লেই চলে। পরীক্ষার প্রশ্ন সেইসব বাজে গাইডের সাথে মিলও থাকে।
কওমি মাদরাসার কিতাব-পত্র প্রকাশনার কোনো নীতিমালা না থাকায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটিপতি হচ্ছে তালেবে ইলমদের অভিভাবকদের পয়সায়। শুধু দাওরায়ে হাদীসের নোট-গাইড ক্রয় করতে খরচ হয় প্রায় বিশ হাজার টাকা। মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা এইসব আজেবাজে নোট-গাইড ক্রয়ে অগ্রসর। যেহেতু উর্দু পারে না, তাই উর্দু কিতাব বাদ। ছেলেদের মাদরাসার তালেবে ইলমরা এখন মহিলাদের ভূমিকায়। উর্দু তারাও বাদ দিচ্ছে। সব নোট বাংলায় ক্রয় করে আলেম হওয়ার স্বপ্ন দেখছে! আরবি শরাহ-শুরুহাত বোঝার জন্য যেটুকু যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন ছিল, তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কারণ উস্তাযরাও মহিলা মাদরাসার ছাত্রীদের অনুসরণ করছেন নোট মোতালাআর ক্ষেত্রে। এটি এখন দোষের কিছু না। পরীক্ষায় পাস বা ভালো ফলাফল এখন মুখ্য। ভালো আলেম না হলেও চলবে। বক্তা বা ইমামের জন্য এত ইলম দরকার নেই। আর মাদরাসায় পড়ানোর জন্য তো বাংলা নোট আছেই। আরবির জন্য এত মেহনতের প্রয়োজন কি?
দেশে হাজার হাজার কওমি মাদরাসা, লাখ লাখ তালেবে ইলম। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কিতাব বিক্রি হয়। তালেবে ইলমরা উচ্চমূল্যে কিতাব ক্রয় করতে বাধ্য হয়। নানা মাকতাবা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে তালেবে ইলমদের কাছ থেকে; অথচ এই মাকতাবাগুলো নিম্নমানের নোট-গাইড প্রকাশ করে ইলমী ইনহিতাতের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে মাদরাসাগুলোকে।
ইদানীং কোনো কোনো প্রকাশনী মুহতামিমদের মোটা অংকের হাদিয়ার নামে ঘুষও দিচ্ছে, যেন মাদরাসা তাদের মাকতাবার প্রকাশিত কিতাবগুলো ক্রয় করে। দেশজুড়ে তাদের অসততার নেটওয়ার্ক। এইসব দেখার কেউ নেই। আলিয়া মাদরাসার আদলে কওমি মাদরাসার কোনো কোনো আলেমের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে গাইডে। ‘ফাযেলে দেওবন্দ’ লকব লেজুড় হিসেবে থাকে সেইসব নামের সাথে।
এইসব হালাকু খাঁরা উর্দু কায়দারও উচ্চারণসহ নোট প্রকাশ করেছে। আগামীতে হাদীসের উচ্চারণসহ নোট বের করবে বলে মনে হচ্ছে। সেইসব খালাকু খাঁদের প্রয়োজন টাকা এবং টাকা। ইলম গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কী? মাদরাসাগুলোর অসচেতনতাকে পুঁজি করে সেইসব লুটেরারা কিতাব-বাণিজ্য করে কোটিপতি হচ্ছে। অথচ কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে কিতাব-পত্রের ক্ষেত্রে এত অরাজকতা হতো না।
গত এক শতাব্দীতে কওমি কর্তৃপক্ষ নিসাবের কিতাবগুলো উন্নত মানে ছাপার জন্য একটি প্রেসও দিতে পারলো না? নিসাবের কিতাবগুলো নির্ভুলভাবে ছাপার একদল যোগ্য লোকও তৈরি করতে পারলো না? প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ বঞ্চিত হচ্ছে কওমি কর্তৃপক্ষ- এই সহজ উপলব্ধিটি নেই কেন? তানজিম, বেফাক আরও কিছু বোর্ড কিছু কিছু বই-কিতাব প্রকাশ করেছে; তাতেই কোটি টাকার উপরে আয় থাকে বছর শেষে। যদিও বইগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।
নিসাবের কিতাব নিজেরা ছাপিয়ে যদি নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ করে কিতাবের এই বাণিজ্যটা কওমি কর্তৃপক্ষ করতো, তাহলে লাভবান হতো কওমি মাদরাসা। নিয়ন্ত্রণ হতো কিতাবের মান। রক্ষা পেত কওমি স্বার্থ। কিন্তু হচ্ছে না কেন? প্রশ্ন হবে, কে কওমি কর্তৃপক্ষ? এইসব প্রশ্ন থাক।
প্রস্তাবনা
দ্রুত গঠন করা হোক একটি কওমি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এটি আবার বেফাক নয়। বেফাক পরীক্ষা নেবে। এই বোর্ড হবে পৃথক। সকল বোর্ডের সম্মিলিত পরামর্শক্রমে হবে এই বোর্ড। এই বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোনো কিতাব মাদরাসায় পড়ানো হবে না। এর জন্য একটি রূপরেখা তৈরিতে দেশের কওমি ধারার শিক্ষাবিদদের কাজে লাগানো যেতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজন নেই। পরিকল্পনা প্রয়োজন প্রথমে।
এই বোর্ড হলে কওমি মাদরাসা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবে। কর্মসংস্থান হবে অনেকের। আর্থিকভাবে লাভবান হবে কওমি মাদরাসা। তালেবে ইলমরা সুলভে কিতাব কিনতে পারবে। বন্ধ হবে অরাজকতা। মাদরাসায় সকল নোট-গাইড উস্তায-তালেবে ইলমদের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। মূল কিতাব থাকবে। সর্বোচ্চ আরবি শরাহ-শুরুহাত- তাও প্রয়োজনে রচিত হবে বা তাখলিস করা হবে। এই বোর্ড সময়ের প্রয়োজন উপলব্ধি করে নতুন নতুন কিতাব উপহার দেবে, যা পাঠ্যভুক্ত হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহ

