Logo

শিক্ষা

দ্বীনি মাদরাসা ও আধুনিক জ্ঞান

Icon

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:২৮

দ্বীনি মাদরাসা ও আধুনিক জ্ঞান

ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার জ্ঞানতাত্ত্বিক বিন্যাসে দ্বীনি মাদরাসা প্রারম্ভিক যুগ থেকেই এক অনন্য, স্থায়ী ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ইলম চর্চা, তাহজিব-তামাদ্দুন ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ-এর মাধ্যমে আদর্শ মানবগঠনের যে বহুমাত্রিক পরিসরে ইসলামী সভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়েছে, মাদরাসা সেই পরিসরের কেন্দ্রীয় ও চালিকাশক্তিস্বরূপ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে সমকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ, পেশাগত দক্ষতার পরিমণ্ডলে মৌলিক রূপান্তর এবং শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত বৈচিত্র্যের ফলে মাদরাসার মৌলিক লক্ষ্য এবং আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে এর সম্পর্ক বিষয়ে সমাজে কিছু দ্বিধা, অস্পষ্টতা ও ভুল-বোঝাবুঝি দৃষ্টিগোচর হয়। এমন পরিস্থিতিতে মাদরাসা-অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকদের প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যাখ্যা ও নীতিগত দিকনির্দেশনা এসব বিভ্রান্তি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।

এই লেখায় প্রধানত দুটি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত বিষয় তুলে ধরা হবে।

প্রথমত, দ্বীনি মাদরাসার প্রাথমিক, চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় উদ্দেশ্য; যা এর স্বরূপ, পরিচয় ও অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তি নির্মাণ করে।

দ্বিতীয়ত, সমকালীন পাঠ্যসূচিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা, সময়োপযোগী প্রাসঙ্গিকতা এবং নীতিগত যুক্তির উপস্থাপন।

মাদরাসার মৌলিক লক্ষ্য মুহাক্কিক ও হক্কানি আলেম তৈরি করা। দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান শিক্ষা, তার সংরক্ষণ, প্রচার এবং আল্লাহওয়ালা আলেম তৈরি করা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এমন প্রজন্ম গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। যারা হবেন মুহাক্কিক হক্কানি আলেম ও দাঈ ইলাল্লাহ। তারা কুরআন ও হাদিসের মৌলিক উৎস নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে সক্ষম। যারা দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগকারী, খোদাভীরু এবং সুন্নতের অনুসারী। তারা ইসলামের বার্তা কার্যকরভাবে সমাজের সকল স্তরে পৌঁছে দেবেন।

মাদরাসা কোনো সাধারণ শিক্ষালয় নয় এবং ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করার জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কোনো মাদরাসার ছাত্র যদি পরবর্তী জীবনে জাগতিক উচ্চ পদ-পদবি লাভ করে তা অবশ্যই ব্যক্তিগত সম্মানের বিষয়। তবে মাদরাসার সাফল্যের পরিমাপ কখনোই এই জাগতিক মানদণ্ড দ্বারা করা হয় না। মাদরাসার একমাত্র লক্ষ্য হলো আল্লাহভীরু, চরিত্রবান, মুহাক্কিক ও সুন্নাহ অনুসারী আলেম তৈরি করা। এই মৌলিক উদ্দেশ্য থেকে সরে আসা মাদরাসার মূল অস্তিত্বকেই দুর্বল করে দিতে পারে।

আধুনিক জ্ঞানের সংযোজন দাওয়াতের অপরিহার্য কৌশল: যখন মাদরাসার শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক স্তরে (মুতাওয়াসসিতা) কিছু আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন প্রায়শই এমন ভুল ধারণা তৈরি হয় যে মাদরাসা হয়তো পেশাগত শিক্ষা প্রদানের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু এই উদ্যোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী তৈরি করা নয়। বরং এটি দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল।

এই সংযোজনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো—মানুষের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী তাদের সাথে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন। দাওয়াতের ক্ষেত্রে নীতি হলো পরিবেশের উপযোগিতা অনুযায়ী কথার বিষয়, শৈলী ও উপস্থাপনা নির্বাচন করার দক্ষতা।

আজকের আধুনিক বিশ্বে একজন আলেম যখন ইসলামের বার্তা নিয়ে মানুষের সামনে দাঁড়ান, তখন তাকে অবশ্যই মানুষের মানসিকতা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি, যৌক্তিক প্রশ্ন ও জীবন-প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। তাই আধুনিক জ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা না থাকলে, যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের মানসিকতার উপযোগী ভাষায় কার্যকরভাবে দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হয় না। এই নীতি মূলত কুরআনের নির্দেশনা থেকে উৎসারিত, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার জনগোষ্ঠীর ভাষা-রীতিতে পাঠিয়েছি।’ এখানে ‘ভাষা’ বলতে কেবল শব্দভান্ডার নয়, বরং জাতিগোষ্ঠীর চিন্তার কাঠামো, সামাজিক রীতি, বোধ-বিশ্বাস এবং প্রকাশের শৈলী সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। ফিকাহ শাস্ত্রের নীতি ‘যে ব্যক্তি তার যুগের মানুষের অবস্থা না জানে সে প্রকৃত অর্থে অজ্ঞ’ এই যৌক্তিকতাকে সমর্থন করে। অতএব, দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য এই প্রাথমিক আধুনিক জ্ঞান অপরিহার্য প্রস্তুতি মাত্র এবং এটি মাদরাসার মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী নয়।

জ্ঞানার্জন ও ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়-

আধুনিক বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। তা হলো-এই জ্ঞান যেন নাস্তিকতার বীজ বা ইসলাম-বিরোধী কোনো ধারণা বহন না করে।

এ কারণে মাদরাসা এমন বিজ্ঞান শেখাতে চায় যা মানুষকে আল্লাহর পরিচয় উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। এমন ইতিহাস যা ইসলামের গৌরব হৃদয়ে জাগাবে। এমন গণিত শেখানো হবে যা ইসলামী অর্থনীতি ও যাকাতের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়ক হবে। উদ্দেশ্য হলো, পাঠ্যক্রমের প্রতিটি বিষয়বস্তু যেন দ্বীন ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা রঞ্জিত হয়। এর জন্য ইসলামী চেতনায় রঙিন কারিকুলাম প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

দ্বীনি পেশাজীবী তৈরির জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা

আর দ্বীনী মানসিকতার পেশাজীবী তৈরি করা মাদরাসার মূল কাজ না হলেও বর্তমান সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা এটি। সামরিক, বেসামরিক এবং বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে এমন মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, যারা দক্ষতা, মুসলিম চরিত্র, দ্বীনী মানসিকতা এবং আল্লাহভীরু হৃদয়ের অধিকারী হবেন।

এই চাহিদা পূরণের জন্য মাদরাসার মূল কাঠামোর বাইরে পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করা উচিত। মাদরাসার লোকেরা এই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে এগুলোর কার্যক্রম মাদরাসার মূল শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হবে না। এই ব্যবস্থায় দুটি ধারা সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে।

মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)-এর উক্তি এই ধারণাকে সমর্থন করে: ‘আলেম নিজে প্রশাসক হতে চান না, বরং চান প্রশাসকরা যেন সামান্য হলেও দ্বীনী মানসিকতা সম্পন্ন হন।’ সমাজে দ্বীনদার পেশাজীবী তৈরির এই আকাক্সক্ষা পূরণের জন্যই দুটি পৃথক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

দ্বীনী শিক্ষা ও আধুনিক সমাজের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে একটি সুচিন্তিত সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আলেমদের গ্রহণ করা সময়ের দাবি। মাদরাসার মূল লক্ষ্য সর্বদা খোদাভীরু আলেম তৈরি করা, পেশাজীবী নয়। একই সঙ্গে, সমাজে দ্বীনদার পেশাজীবী তৈরির জন্য মাদরাসার মূল কাঠামোর বাইরে পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রকল্প গ্রহণ; এই দ্বিমুখী ও সুসংগঠিত দৃষ্টিভঙ্গিই পারে মাদরাসা শিক্ষা এবং আধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর