Logo

শিক্ষা

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশ

Icon

মো. মাহমুদুল হাসান

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৩

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশ

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাসের জন্য কিছু মূল্যবোধ ও নৈতিক আদর্শ অনুসরণ করা আবশ্যক, যা সামাজিক শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তি রচনা করে। এই সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং পরবর্তীতে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পূর্বশর্ত। 

প্রাথমিক শিক্ষা হলো একটি শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ, যেখানে তার চারিত্রিক গঠন ও মূল্যবোধের বীজ রোপণ করা হয়। এ পর্যায়ের পাঠ্যবই ও পাঠ্যক্রমে সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।

সামাজিক মূল্যবোধ হলো সমাজের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, আচার-আচরণ এবং কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার জন্য কিছুনীতি ও আদর্শ। যেমন: বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, অতিথিদের প্রতি সম্মান জানানো, ছোটদের স্নেহ করা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, পারষ্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। 

শিশুদের চারিত্রিক গঠন ও ভবিষ্যৎ নাগরিক রূপে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলি বিকাশে পাঠ্যবইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০২১-এ সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 

কিন্তু বাস্তবতায় প্রশ্ন দেখা দেয়-শিশুরা কি এসব মূল্যবোধ আত্মস্থ করতে পারছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষায় মূল্যবোধ সংযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে কীভাবে সামাজিক মূল্যবোধ শেখানো হচ্ছে এবং আরও কীভাবে তা উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সুপারিশ এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত সামাজিক মূল্যবোধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার সুযোগ ২০২৫ সালে এনসিটিবি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) কর্তৃক প্রকাশিত প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইসমূহে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সংক্রান্ত বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। নিচে শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্যবই অনুযায়ী পাঠ ও সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধগুলো তুলে ধরা হলো:

প্রাক-প্রাথমিক সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রমে: ভদ্রতা, ভাগাভাগি ও নম্রতা শেখানো হয় খেলাধুলা ও গ্রুপ এক্টিভিটির মাধ্যমে (বিশেষত সূচনা পাঠ্যক্রমে)। গান ও ছড়ার মাধ্যমে-‘একসাথে খেলো, সবাই হাসো’- সহযোগিতা ও সম্মানস্বরূপ আচরণে উৎসাহ দেওয়া হয়।

প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ‘বাঘ ও রাখাল’ গল্পে মিথ্যা বলার অপকারিতা ও নেতিবাচক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, সামাজিক মূল্যবোধ শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া দিক তুলে ধরে সত্য বলতে উৎসাহিত করা হয়েছে। 

‘পিঁপড়া ও পায়রা’ গল্পে একে অপরের বিপদে সাহায্য ও সহযোগিতা বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির ‘জলপরি ও কাঠুরে’ গল্পে সত্য কথা বলা ও এর ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। ‘সিংহ ও ইঁদুরছানা’ গল্পে কাওকে অবহেলা না করার বিষয়টা তুলে ধরা হয়েছে।

তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘ব্যাঙের সাজা’ গল্পে গুজব ছড়িয়ে শান্তি নষ্ট না করা বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় সহমর্মিতা ও সকলে মিলে মিশে থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞান বই-এ পানির ব্যবহার ও এর গুরুত্ব এবং অপব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বই-এ ‘আমরা সবাই মানুষ’, ‘নৈতিক ও মানবিক গুণ’ পাঠে মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদান তুলে ধরা হয়েছে। ধর্ম শিক্ষা বই-এ চরিত্র গঠনে সহিষ্ণুতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া ও আন্তরিকতার বিষয়সমূহ তুলে ধরা হয়েছে।

চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘বীরশ্রেষ্ঠদের বীরগাঁথা’ এবং পঞ্চম শ্রেণির বই-এ ‘বীরের রক্তে স্বাধীন এই দেশ’ দেশ প্রেমের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ পাঠে শিক্ষককে সম্মান ও শ্রদ্ধা বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘আমাদের পরিবেশ ও সমাজ’ পাঠে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নাগরিক দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞান বইয়ে ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা’ পরিবেশ দূষণ, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ’ প্রভৃতি পাঠে পরিবেশ সচেতনতা ও সংরক্ষণ-সদ্যবহার মূল্যবোধ ফুটে উঠেছে।

এছাড়াও সার্বিকভাবে পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতা বিষয়য়ক গল্প ও কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা শিশুদের নৈতিক শিক্ষা প্রদানে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘সততার পুরস্কার’, ‘সাহসী খোকা’ ইত্যাদি গল্পশিশুদের নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা দেয়। ছড়া ও গানের মাধ্যমেও শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখানো যায়। যেমন,

‘আমাদের গ্রাম’, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ইত্যাদি ছড়া ও গানের মাধ্যমে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ধারণা দেওয়া হয়। 

চিত্রাঙ্কন ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করার মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে এবং অন্যের মতামতকে সম্মান করতে শেখে।

শিশু হলো সম্ভাবনার শিখা, যেখানে সুপ্ত থাকে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, মননশীলতা ও মানবিকতার বীজ। এই সুপ্ত প্রতিভাবানদের ভিত রচিত হয় শৈশবেই-বিশেষ করে

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা একজন শিশুর পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ঠার জন্য অপরিহার্য। প্রাথমিক পাঠ্যক্রমে এর অন্তর্ভুক্তি প্রশংসনীয়

হলেও আরও উদ্ভাবনী ও বাস্তবভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ-তিনটির সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই শিশুর নৈতিক বিকাশ সম্ভব। একজন সৎ, দায়িত্ববান ও মানবিক নাগরিক গঠনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষায় সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। 

সূত্র : প্রাথমিক শিক্ষা বার্তা।

লেখক : সহাকারী বিশেষজ্ঞ, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

প্রাথমিক শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর