আন্দোলনে শিক্ষকরা, ব্যাহত হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষা
রেজাউল করিম হীরা
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯
সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক, নির্বাচনী ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে আগেই। কিন্তু সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে মাধ্যমিক ও প্রাথমিকর শিক্ষকরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। ফলে বেশির ভাগ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না। গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাউশির জারি করা সর্বশেষ নির্দেশনায় বার্ষিক পরীক্ষা ২০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর, নির্বাচনী পরীক্ষা ২৭ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর এবং জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সম্পন্ন করার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
নির্দেশনায় সব সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া পরীক্ষাকালীন শৈথিল্য বা অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির কথাও জানানো হয়েছে নির্দেশনায়। কিন্তু এই নির্দেশনার পরও শিক্ষকরা দাবি-দাওয়ার পক্ষে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। এতে আসন্ন পরীক্ষাগুলো নির্বিঘ্নে আয়োজন নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আন্দোলন আরও সক্রিয় করার লক্ষ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে তারা নিয়মিত বৈঠক করছেন। পরীক্ষার চাপের মধ্যেও চলমান আন্দোলন থামানোর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি শিক্ষকদের।
চার দফা দাবিতে ‘বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি-বাসমাশিসের’ ব্যানারে আন্দোলনরত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত বৃহস্পতি ও রোববার রাজধানীর ‘শিক্ষা ভবন’ চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পর গতকাল সোমবার থেকে কর্মবিরতি শুরুর ঘোষণা দেন। প্রাথমিক স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষাও গতকাল শুরু হওয়ার কথা ছিল। ফলে প্রাথমিকের শিক্ষকদের একাংশ বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন করে কর্মবিরতি কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ সরকারি স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে।
শিক্ষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে গড়িমসি চলায় তারা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে পরীক্ষার ঠিক আগে এ ধরনের তৎপরতায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসন সবাই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, পরীক্ষাকালীন যেকোনো অস্থিরতা সংঘটনের ঝুঁকি রয়েছে- তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা সমন্বয়কারী বৈঠক করছেন।
রাজধানীর সবুজবাগ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্কুলটির সিনিয়র শিক্ষক ও বাসমাশিসের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, চার দাবিতে মাউশি চত্বরে দুই দিন অবস্থান কর্মসূচি পালনের পরও আমাদের সঙ্গে সরকার বা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কেউ আলোচনা করেননি। তাই আমরা কর্মবিরতি শুরু করেছি। স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত আছে।
শেরপুরের সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমিতেও বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্কুলটির সহকারী শিক্ষক আনিস রহমান। তিনি বলেন, আমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষ গত রাতেই পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে নোটিস জারি করেছে। সহকারী শিক্ষকদের বছরের পর বছর বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত ও দ্রুত সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। চট্টগ্রামের পটিয়ার আবদুর রহমান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্কুলটি সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ মাহফুজুল আলম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ গতকাল শুরু হতে যাওয়া বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রেখে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন।
‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ কয়েক দিন আগে দশম গ্রেডে বেতনসহ তিন দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছেন। পরে একাদশ গ্রেডে বেতনের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেন।
নোয়াখালী সদর উপজেলার ত্রিপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি পালনের তথ্য দিয়েছেন স্কুলটির শিক্ষক এবং ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ।
তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস অনুযায়ী তিন দফা দাবির মধ্যে একাদশ গ্রেডের প্রজ্ঞাপন জারি ও অন্যান্য দাবি বাস্তবায়নে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়ায় আমরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আপাতত একাদশ গ্রেডসহ তিন দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, আজ (গতকাল) থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আমরা সে কর্মবিরতিতে অটল আছি, বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত আছে।
তবে, গ্রেড ও পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা নিরসনের তিন দাবি পূরণে গত মঙ্গলবার থেকে ‘তিন দিনের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি’ পালন করে রোববার থেকে ক্লাসে ফিরেছেন প্রাথমিকের শিক্ষকদের বারোটি সংগঠনের মোর্চা ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ অনুসারীরা; তারা বার্ষিক পরীক্ষা নিচ্ছেন।
এ মোর্চাভুক্ত সংগঠন ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের’ সভাপতি শাহীনুর আল আমিন বলেন, আমরা তিন দিন লাগাতার কর্মবিরতি পালন শেষে গতকাল (রোববার) ক্লাসে ফিরেছি। আজ (গতকাল) থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে, আমরা বাচ্চাদের জিম্মি করে কোনো কর্মসূচি নেব না।
জানতে চাইলে মাউশির একজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি নির্দেশনার পরও যদি পরীক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় বা কর্তব্যে অবহেলা পাওয়া যায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবেন এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না।
পরীক্ষার সময়সূচি কঠোরভাবে অনুসরণ ও পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ওপর সরকার জোর দিচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে চলমান আন্দোলন কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন- পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হবে তো?
উল্লেখ্য, প্রাথমিকের চারটি দাবি হলো সহকারী শিক্ষক পদ নবম গ্রেডে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত ও দ্রুত সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করে গেজেট প্রকাশ।
বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্যপদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ তিন কর্মদিবসের মধ্যে দেওয়া। ২০১৫ সালের পূর্বের মত সহকারী শিক্ষকদের ২-৩টি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ। এর আগে দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবিতে গত ৮ নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।

