ইমাম বুখারী (রহ.) সম্পর্কে এক কিংবদন্তি আলেম ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই একবার বলেছিলেন, “যদি পৃথিবীতে হাদিস সংরক্ষণের জন্য কোনো মানুষ বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সে মানুষটি হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী।” এই প্রশংসা নিছক শৈল্পিক অলংকার নয়; বরং এটি ইতিহাসের এক অনিবার্য সত্য। মানবসভ্যতার জ্ঞানভাণ্ডারে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের আলো যুগ থেকে যুগান্তরে পথ দেখায়; যাঁরা সময়, ভৌগোলিকতা বা সভ্যতার সীমানা অতিক্রম করে মানবতার জন্য চিরন্তন দিশারি হয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ হলেন হাদিসশাস্ত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ইমাম বুখারী (রহ.)। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গভীর শ্রদ্ধা, গভীর বিশ্বাস ও নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে; কারণ তিনি শুধু হাদিসের সংগ্রাহক নন, তিনি ইসলামী জ্ঞানের শৃঙ্খলাকে রক্ষা করা ইতিহাসের অন্যতম বিরল মনীষী।
ইমাম বুখারীর জীবন কেবল একটি ব্যক্তিজীবনের গল্প নয়; এটি জ্ঞানতৃষ্ণা, পরিশ্রম, সততা, তাকওয়া ও গবেষণার এক অমর মহাকাব্য। তাঁকে বুঝতে হলে প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে তাঁর জন্মপরিবেশ ও বেড়ে ওঠার বিশুদ্ধতার গল্প। ৮১০ খ্রিস্টাব্দে (১৯৪ হিজরি) বুখারা নগরীতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ইসমাঈল ছিলেন স্বনামধন্য আলেম, আর তাঁর মা ছিলেন ধার্মিক ও বিদুষী নারী। কথিত আছে, শৈশবেই ইমাম বুখারী দৃষ্টিশক্তি হারান; কিন্তু মায়ের অবিরাম দোয়া ও আল্লাহর রহমতে তাঁর দৃষ্টি ফিরে আসে। এই ঘটনাটি তাঁর জীবনে অদ্ভুতভাবে ছাপ ফেলেছিল। যেন তিনি বুঝতে শেখেন, আল্লাহর কুদরত যাকে বেছে নেন, তার কাছে বড় বড় কাজ কঠিন নয়।
শিক্ষাজীবনের সূচনা থেকেই তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদিস মুখস্থ করা শুরু করেন, আর মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি তাঁর শিক্ষকের সামনে হাজার হাজার হাদিস নিখুঁতভাবে আবৃত্তি করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অলৌকিক পর্যায়ের। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, তিনি একবার বাসরায় গিয়েছিলেন, যেখানে হাদিসশিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদিসের সনদ ও মতন অদল-বদল করে তাঁকে ভুল ধরার জন্য পরীক্ষা নেন। কিন্তু তিনি একে একে সব ভুল শনাক্ত করে সঠিক সনদ ও মতন তাদের সামনে তুলে ধরেন। সেই দিন থেকেই মানুষ বুঝতে পারে এই যুবকই একদিন হাদিসের সমুদ্রকে কল্যাণের জন্য সুবিন্যস্ত করে মানবতার সামনে উপস্থাপন করবেন।
তাঁর জ্ঞানার্জনের পথ ছিল দুরূহ ও দুঃসাহসে পূর্ণ। তিনি সমগ্র ইসলামি ভূখণ্ডে সফর করেছেন- বুখারা, নিশাপুর, বাগদাদ, কুফা, মিশর, হিজাজ, দামেস্ক যেখানে যে বিশ্বস্ত আলেম ছিলেন, তিনি সেখানে গেছেন। কখনো দুর্ভিক্ষ, কখনো নিঃস্বতা, কখনো দীর্ঘ পথের কষ্ট কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। রাতে অন্ধকারে উঠোনে বসে প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় তিনি হাদিসের বর্ণনাগুলো লিখেছেন, বাছাই করেছেন, যাচাই করেছেন। কখনো কখনো ঘুমাতে গিয়ে একটি সনদ তাঁর মনে এলে ঘুম ভেঙে উঠে আবার কলম ধরেছেন। এই অমানুষিক পরিশ্রম আর আল্লাহর প্রতি তীব্র আস্থাই তাঁকে তৈরি করেছে ইসলামী জ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষক হিসেবে।
হাদিস সংগ্রহে তাঁর পদ্ধতি ছিল অবিশ্বাস্য কঠোর। তিনি এক লাখেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন; প্রায় ছয় লাখের বেশি হাদিস সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বাছাই করার সময় তাঁর শর্ত এত কঠোর ছিল যে, সেখান থেকে মাত্র সাত-আট হাজার (পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে প্রায় চার হাজার) হাদিস তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-জামি’ আস-সাহিহ বিশ্বজোড়া পরিচিত সহিহ বুখারীতে সংকলন করেন। তাঁর পদ্ধতি ছিল এমন কঠোর যে আজকের পৃথিবীর কোনো গবেষণার ক্ষেত্রেই এমন গভীর যাচাই দেখা বিরল। তিনি বর্ণনাকারীর চরিত্র, সততা, স্মৃতিশক্তি, জীবনাচরণ, ভ্রমণের তথ্য সবকিছু পরীক্ষা করতেন। কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে সামান্য শঙ্কাও থাকলে তিনি তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করতেন না। একবার তিনি একটি হাদিস নিতে গিয়েছিলেন এক ব্যক্তির কাছে। দূর থেকে দেখে তিনি বুঝলেন লোকটি তার গাধাকে ধরার জন্য ঝুড়িতে খাবার আছে- এমন ভান করছে। এই ছোট প্রতারণা দেখে ইমাম বুখারী তার কাছ থেকে একটিও হাদিস গ্রহণ করেননি। তাঁর এই সততার মাপকাঠি হাদিসকে যে নির্ভুল উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল।
সহিহ বুখারীর রচনাপদ্ধতি ছিল শুধু বাছাই-সংগ্রহ নয়; বরং তা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাতাত্ত্বিক, শাস্ত্রগত ও তাত্ত্বিক বিশে¬ষণের এক মহাগ্রন্থ। তিনি অধ্যায় বিন্যাসে অনন্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম তিনি এমনভাবে রচনা করেছেন, যা আলেমদের কাছে নিজেই একটি গবেষণার বিষয়। তাঁর বইয়ের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কাঠামোতে রয়েছে গভীর চিন্তার ছাপ। এজন্য সহিহ বুখারী আজ শুধু একটি হাদিসগ্রন্থ নয় বরং এটি একটি বিশ্বমানের গবেষণাপদ্ধতি, একটি জ্ঞানের স্থাপত্য।
এর গুরুত্ব ও মর্যাদা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে আলেমরা এক বাক্যে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন- “কোরআনের পরে মানুষের রচিত সবচেয়ে ধঁঃযবহঃরপ, সবচেয়ে নির্ভুল গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারী।” এই মর্যাদা কোনো দাক্ষিণ্য নয়; এটি সেই কঠোরতা, গবেষণা, সততা ও আল্লাহভীতির বাস্তব স্বীকৃতি। সহিহ বুখারী কুরআনের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এই শ্রদ্ধা শুধু মুসলমানদের আবেগ নয়; বরং এটি যুগে-যুগে হাজারো আলেমের গবেষণার ফল।
ইমাম বুখারীর ব্যক্তিজীবন ছিল এক অনিন্দ্য নৈতিক চরিত্রের প্রতিফলন। তিনি কখনো রাজনীতি, ক্ষমতা বা দুনিয়াবি লাভের দিকে যায়নি। তিনি ছিলেন নির্লোভ, বিনয়ী, মেধাবী, ধ্যানমগ্ন মানুষ। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছেন সত্যের অন্বেষণে। তাঁর তাকওয়া এত গভীর ছিল যে, তিনি গবেষণা শুরু করার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যাতে তিনি কোনো ভুল হাদিস সংকলন না করে ফেলেন। তার চরিত্রের পবিত্রতা তাঁর গ্রন্থের মতোই নির্মল।
তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও আছেন ইতিহাসের কিংবদন্তিরা, ইমাম তিরমিজি, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী প্রমুখ মহান মুজতাহিদ ও হাদিস বিশারদ। বিশেষত ইমাম মুসলিম তাঁর প্রতি এমন শ্রদ্ধা পোষণ করতেন যে বলেছেন- “তোমার মতো আর কেউ নেই পৃথিবীতে; তুমি হাদিস বিজ্ঞানের প্রকৃত নেতা।” তাঁর ছাত্ররা কেবল তাঁর জ্ঞানই নয়, তাঁর নৈতিকতা ও গবেষণার আদর্শও উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করেন। তাই হাদিসশাস্ত্রের পরবর্তী প্রজন্মসমূহও তার প্রভাব বহন করে।
হাদিসশাস্ত্রে ইমাম বুখারীর সামগ্রিক অবদান শুধু একটি বই রচনা নয়; তিনি হাদিসকে সংরক্ষণের একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বর্ণনাকারীর সততা যাচাইয়ের মানদণ্ড তৈরি করেছেন, সনদের শুদ্ধতা নির্ধারণ করেছেন, বর্ণনাসম্ভাবনা যাচাইয়ের পদ্ধতি দিয়েছেন এবং জ্ঞানের স্বচ্ছতা কীভাবে রক্ষা করা যায় তা শিখিয়েছেন। আজকের সময়ে গবেষণা, তথ্য যাচাই বা বৈজ্ঞানিক কড়াকড়িগুলো যেভাবে হয় ইমাম বুখারীর পদ্ধতি ছিল তারও শত শত বছর আগের উন্নত রূপ। তাই তাঁর অবদান সীমিত নয়; এটি কেয়ামত পর্যন্ত প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
ইমাম বুখারীর কাজ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নয়; সমগ্র মানবতার জন্য। তিনি সত্যকে লিপিবদ্ধ করেছেন, ইতিহাসকে রক্ষা করেছেন, নবীজির (সা.) শিক্ষাকে নিরাপদ রেখেছেন। তাঁর হাত ধরে নবীজির সুন্নাহ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবনে আলো ছড়াতে পারবে এটাই তাঁর অনন্য কীর্তি।
আজকের যুগে আমরা প্রযুক্তি, আধুনিকতা ও জটিলতার যুগে বাস করছি। তথ্যবিপ্লবের এই সময়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যখন নির্ভুল জ্ঞানের সন্ধানে ভাসছে, তখন ইমাম বুখারীর গ্রন্থ এক অবিচল লণ্ঠনের মতো অনির্বাণ আলো জ্বালিয়ে রাখে। এই আলো সভ্যতার নদীর মতো চিরকাল প্রবাহিত হবে।
ইমাম বুখারী কেবল একজন আলেমই নন; তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সভ্যতার প্রতীক, একটি জ্ঞানের দুর্গ যার উপর দাঁড়িয়ে ইসলামি জ্ঞানের ইতিহাস স্থিত হয়ে আছে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, নিষ্ঠা, বিনয়, সততা ও আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা দিয়ে মানুষ অমর হয়ে উঠতে পারে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন সত্যের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে সময়ের সীমা ভেঙে যুগের ওপারে চিরভাস্বর হওয়া যায়।
কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর কাজ মানবতার পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে। আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাঁর নাম উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মুমিনের হৃদয়ের গভীরতম কৃতজ্ঞতা নিয়ে। সহিহ বুখারী কুরআনের পরে সবচেয়ে নির্ভুল ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যেমন কালজয়ী, তেমনি ইমাম বুখারীর জীবনও সত্য ও নৈতিকতার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে চিরভাসমান থাকবে।
ইমাম বুখারীর জীবনের শেষ অধ্যায়ও তাঁর কর্মযজ্ঞের মতোই শান্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও গাম্ভীর্যে পূর্ণ ছিল। জীবনের শেষ সময়ে তিনি বুখারা ত্যাগ করে সামরকন্দের নিকটবর্তী খারতাঙ্ক গ্রামে অবস্থান নেন, যেখানে তিনি মানুষের ঈর্ষা ও রাজনৈতিক চাপে নির্জনতা বেছে নিয়েছিলেন। ২৫৬ হিজরির শাওয়ালের শেষ রাতে তিনি সুরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করতে করতে নিশ্চুপভাবে ইহলোক ত্যাগ করেন। গ্রামের মানুষ ভিড় করে তাঁর জানাজায় অংশ নেয় এবং তাঁকে সেখানেই কবরস্থ করা হয়। আজও সেই কবরস্থান ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে তাঁর জ্ঞান, আত্মত্যাগ ও আমানতের প্রতি অসীম নিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লেখক : কলামিস্ট, এমফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ

