কওমি শিক্ষায় নিকাহ রেজিস্টার
সামাজিক ভারসাম্যের বার্তা
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:১০
“এখন থেকে কওমী মাদরাসার স্বীকৃত ডিগ্রিধারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবেন। আগে এই সুযোগ আলিম সনদধারী ব্যক্তিদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিলো। আইন মন্ত্রণালয় এই সুযোগ বাড়ানোর জন্য আইন সংশোধন করেছে। আজ থেকে কওমী মাদরাসার স্বীকৃত বোর্ড হতে দাওরায়ে হাদিস সনদধারী ব্যক্তিরাও এই পদে আবেদন করতে পারবেন।”
আইন উপদেষ্টার এই বক্তব্যটি নিছক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নয়; এটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে ধর্মীয় শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার দীর্ঘদিনের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয় অনুশাসন, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে এই ধারার অবদান অনস্বীকার্য। অথচ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সরকারি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এই ধারার শিক্ষার্থীদের সুযোগ দীর্ঘদিন ধরে সীমিত ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদের নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী হিসেবে আবেদনের সুযোগ দেওয়াকে একটি যুগোপযোগী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিবাহ নিবন্ধন শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি আইনি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়। বিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে নারী–পুরুষের অধিকার, উত্তরাধিকার, দেনমোহর এবং পারিবারিক আইনি কাঠামো নিশ্চিত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নতুন একটি শিক্ষাধারার প্রবেশ মানে রাষ্ট্র নাগরিক সেবা ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত করতে চাচ্ছে।
গ্রামবাংলার বাস্তবতা বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বহু প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো নিকাহ নিবন্ধন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত গতিশীল নয়। কাজী পাওয়া যায় না, দূরে শহরে গিয়ে নিবন্ধন করতে হয়, অথবা অনেকে আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন করেন- যার ফলে পরবর্তীতে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়। কওমী শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমরা সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি থাকেন। মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় কেন্দ্রিক তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকায় সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেন। এ কারণে কাজী হিসেবে তাদের যুক্ত হওয়া বিয়ে নিবন্ধন ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও কার্যকর করতে পারে।
তবে এই উদ্যোগের পথটি যে পুরোপুরি মসৃণ, তা বলা যাবে না। সমাজে মতের ভিন্নতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ এটিকে অতিরিক্ত ধর্মীয়করণ বলেও ব্যাখ্যা করতে পারেন, আবার কেউ কেউ একে দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন হিসেবে দেখবেন। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন ধারার নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে, তখন সেটিকে রাজনৈতিক নয়, বরং প্রশাসনিক ও সামাজিক ভারসাম্যের অংশ হিসেবেই দেখা উচিত।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যোগ্যতা ও জবাবদিহিতা। কাজী পদটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নয়; এতে আইনি জ্ঞান, নির্ভুল তথ্য সংরক্ষণ, সরকারি বিধি–বিধান মেনে চলা এবং নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বও যুক্ত। সুতরাং কওমী সনদধারীদের জন্য এই সুযোগ তৈরি হয়েছে মানেই স্বয়ংক্রিয় যোগ্যতা ধরে নেওয়া যাবে না। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি প্রশিক্ষণ, সরকারি নিয়মাবলি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং ডিজিটাল নিবন্ধন ব্যবস্থার ব্যবহারিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা জরুরি।
এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইন সংশোধনের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কাঠামো, মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং তদারকি প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হলে এবং নিয়মিত মনিটরিং থাকলে এই উদ্যোগটি বাস্তবে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। অন্যথায়, ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও বাস্তব প্রয়োগে দুর্বলতা দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি পদের সুযোগ বাড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কওমী শিক্ষা ধারার দীর্ঘদিনের সামাজিক অবস্থানকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। অতীতের বিতর্ক, অবিশ্বাস ও দূরত্বের জায়গা থেকে সরে এসে রাষ্ট্র যদি এ শিক্ষাধারাকে ধীরে ধীরে মূলধারার প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে যুক্ত করতে চায়, তবে সেটি জাতীয় ঐক্যের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে। শিক্ষার ধারা আলাদা হতে পারে, কিন্তু নাগরিক হিসেবে অধিকার ও দায়িত্বের জায়গাটি সবার জন্য সমান- এই দর্শনকে শক্তিশালী করবে এমন সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল বহুদিন।
তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, স্বীকৃতি মানেই দায়িত্ব বৃদ্ধি। যখন কোনো গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পায়, তখন তাদের আচরণ, পেশাদারিত্ব এবং নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে জনগণের প্রত্যাশাও বহুগুণ বেড়ে যায়। সুতরাং কওমী শিক্ষাধারার প্রতিনিধিদের এই সুযোগকে কেবল সম্মান হিসেবে নয়, বরং আমানত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের গাফিলতি বা অবহেলা পুরো ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক ছাপ ফেলতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, আইন উপদেষ্টার এই ঘোষণার মাধ্যমে যে নতুন দরজা খুলেছে, তা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। এটি বিভাজনের নয়, বরং সংযুক্তির এক বার্তা। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়, যাতে এই উদ্যোগ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবে সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। রাষ্ট্র ও সমাজ যখন একে অন্যের প্রতি আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে, তখনই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হয়।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক

