২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার “কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮” পাসের মাধ্যমে এই সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমতুল্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এই শিক্ষা কার্যক্রম এবং পরীক্ষা পরিচালনা করে আসছে ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ (অষ-ঐধরধঃঁষ টষুধ খরষ-ঔধসরধঃরষ ছধসিরধ ইধহমষধফবংয) নামক সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। যার অধীনে সরকার স্বীকৃত ছয়টি কওমি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে।
কওমি সনদের স্বীকৃতি পেলেও এর ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং আইনি ভিত্তি নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যা বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। সনদের যথাযথ মূল্যায়ন ও এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বা উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর (শিক্ষা, ধর্ম) মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে।
বাংলাদেশে ক্বওমী সনদ আজও অবহেলার নাম। অথচ দ্বীনি শিক্ষার অন্যতম উৎকৃষ্ট ত্বরিকার নাম ক্বওমী শিক্ষা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা জন্ম নিয়েছে স্বাভাবিক ধারায় নয়- ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতাকামী চেতনা ও দ্বীন রক্ষার প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয় ক্বওমী মাদরাসার। সে হিসেবে এই সিলেবাসটি অন্যরকম। দরসে নেজামী কাঠামোতেই চলছে।বাংলাদেশে ক্ষেত্রবিশেষ সংযুক্তি বা কিঞ্চিত পরিবর্তনও হয়।
আগেকার আকাবিরগণ সনদকে লক্ষ্য করেননি; তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইলম ও আমল, সনদ বা চাকরি নয়। অনেকেই ফারাগাত শেষে আজীবন দাওয়াহ, ইমামতি ও দ্বীনি খিদমতে লিপ্ত থাকতেন। আরেক অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য ভারত-পাকিস্তানের ক্বওমী সিলসিলার মাদরাসায় যেতেন। তদানিন্তন সময়ে ক্বওমী ও আলিয়া ধারার বড় পার্থক্য ছিল; ক্বওমী বেশি আখেরাতমুখী আর আলিয়া দুনিয়া-আখেরাত সমন্বিত। কিন্তু দিনবদলে; আজকের ছাত্ররা চান-ক্বওমীর শিক্ষার্থীরাও আলিয়ার মতো সুযোগ পাক, বিদেশে উচ্চশিক্ষার্জন করুক। বর্তমানে এটি ভালো দিকও হতে পারে। নিম্মে ক্বওমী সনদের মানোন্নয়নে দুইটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হল।
১. সিলেবাসে প্রয়োজনীয় সংযোজন :
বর্তমান সিলেবাস দ্বীনি শিক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ হলেও জেনারেল সুবিধা পেতে হলে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন; ইংরেজি, গণিত, বাংলা, সাধারণ জ্ঞান। (এগুলো যুক্ত হলে মানবিক বিভাগের মা দেয়া যাবে।)
এগুলো আবার দুই পদ্ধতিতে হতে পারে।
(ক) তাখাসসুস পদ্ধতি। দু’ বছরের (তাখাসসবিশেষ কোর্সে উপরোক্ত চার বিষয়ে পাঠ-এক বিষয়ে ছয় মাস। সহজ এবং বাস্তবিকভাবে সম্ভব।
(খ) বর্তমান সিলেবাসের সাথে সমান্তরালে।
হাদিস-ফিকাহ-আরবি চালু রেখে অতিরিক্ত এসব বিষয় যুক্ত করা। প্রয়োজনে কদ্বাস কাঠামো নতুন আঙিকে সাজানো যেতে পারে। তবে সবার জন্য বাধ্যতামূলক না করে ইচ্ছানুযায়ী পৃথক ধারা রাখা যুক্তিযুক্ত, ঠিক যেমন আর্টস/সায়েন্স/কমার্স বিভাগে থাকে।
যারা ফারেগ হয়ে গেছেন তারাও যদি সুবিধা পেতে চান তাহলে, তাদের জন্য ২ বছরের কোর্সে জেনারেল বিষয় শিখে সুবিধা অর্জনের সুযোগ রাখা যায়।
২. বর্তমান কাঠামো বজায় রেখে মর্যাদা বৃদ্ধি :
বর্তমান সিলেবাস দ্বীন শেখার জন্য যথোপযুক্ত। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে সনদের স্বীকৃতি ও কর্মক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন প্রদান করা যায়।
উদাহরণ স্বরূপ :
ক) সরকারি কাজী নিয়োগে ক্বওমী ফারেগদের সুযোগ -বিয়ে, তালাক, ফতোয়া ও মুআমালাত বিষয়ে ক্বওমী শিক্ষা যথেষ্ট ও অধিক গভীর।
আলহামদুলিল্লাহ! দুই-তিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে- এখন থেকে কওমী মাদরাসার ডিগ্রিধারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবেন। আগে এই সুযোগ আলিম সনদধারী ব্যক্তিদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিলো। এই সুযোগ বাড়ানোর জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। সুতরাং কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃত বোর্ড হতে দাওরায়ে হাদিস সনদধারী ব্যক্তিরাও এই পদে আবেদন করতে পারবেন।
খ) বিভিন্ন বাহিনীতে ইমাম নিয়োগে সুযোগ ও কোটা সংরক্ষণ।
গ) আঞ্চলিক শরীয়াহ কোর্ট জারি করে সেখানকার কাজি ইত্যাদি।
ঘ) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সকল ক্ষেত্রে চাকুরির সুযোগ। এই বিষয়ে অবশ্যই ক্বওমীয়া যোগ্য।
এছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কওমিরা বিশেষভাবে যোগ্য। পর্যায়ক্রমে সবগুলো বিষয়েই আলোচনা আসতে পারে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা
যারা বিদেশে পড়তে চান- একটি সহজ পথ হচ্ছে; ক্বওমীর পাশাপাশি আলিয়ায় ভর্তি থেকে আলিম সনদ গ্রহণ করা। আলিম শেষে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হবে।
কওমি ও জেনারেল সনদদারী প্রাক্তন মদিনা শিক্ষক শায়েখ মুহিউদ্দীন ফারুক্বী সাহেব বলেন; কোনো বোর্ড চাইলে প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে মুয়াদালা (স্বীকৃতি চুক্তি) করলে ভর্তি অনুমতি পাওয়া সম্ভব। যদি হাইয়াতুল উলয়া উদ্যোগ নেয় তাহলে মদিনা, উম্মুল ক্বরা, আযহার, মালয়েশিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক, দুবাইসহ বহু দেশে ক্বওমী ছাত্রের উচ্চশিক্ষা-ভর্তি সহজতর হবে। এতে হতাশা কমবে এবং বাস্তবতা উন্মুক্ত হবে।ক
ক্বওমী শিক্ষা আমাদের ইলমের গৌরবময় খনি। সময়ের দাবি-দ্বীনি স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বৃদ্ধি ও জেনারেল সুবিধা সম্প্রসারণ করা উচিৎ; সময়ের দাবিও বটে। মুরব্বিগণের সুদৃষ্টি থাকলে ত্বালাবা ভাইদের ভবিষ্যৎ আরও আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে।
আমাদের মুরব্বিগণের নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক

