গ্রামগঞ্জের মাদরাসা
আরবি ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ সময়ের দাবি
ইমরান নাজির
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:০৭
আলেম মানেই কোরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইলমে বালাগাত ও ইলমে ফাসাহাতের গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। আর আলেম তৈরির কারখানা হচ্ছে কোরআন, হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার মাদরাসাগুলো। আমাদের দেশে মৌলিকভাবে দুই ধরণের মাদরাসা রয়েছে। এক. কওমী মাদরাসা, দুই. আলিয়া কিংবা সরকারি মাদরাসা।
ভারতীয় উপমহাদেশে আলিয়া মাদরাসার যাত্রা শুরু হয় ১৭৮০ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় এবং কোরআন, হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এদেশেও বহু আলিয়া তথা সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যুগ যুগ ধরে এই মাদরাসাগুলো যোগ্য, বিজ্ঞ এবং দক্ষ আলেম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল; কিন্তু কালপরিক্রমায় আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থায় নেমে আসে চরম দুর্দশা। কালের বিবর্তন ও আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থার করুণ পরিণতির দরুণ আজ সেই আলিয়া মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থী কোরআনুল কারীমটা পর্যন্ত শুদ্ধ করে পড়তে পারে না। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। তারা না পাওে কোরআনুল কারীমটা শুদ্ধ করে পড়তে, আর না আছে তাদের নাহু-সরফের ন্যূনতম একটু ব্যাসিক জ্ঞান। গ্রামের একটা স্বনামধন্য আলিয়া মাদরাসার একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি নিজেই এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং ভুক্তভোগী।
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দাখিল-আলিমে পড়েও ছোট্ট একটা আরবি শব্দের তাহকীক কিংবা ছোট্ট একটা আরবি বাক্যের তারকীব কোনো শিক্ষার্থী নিজ থেকে করতে পারছে না। অথচ মাদরাসায় দাখিল নবম-দশম শ্রেণিতে সূরা বাকারা ও আলে ইমরানের তাফসীর পড়ানো হয় আর আলিম শ্রেণিতে পাঠদান করানো হয় হাদীসশাস্ত্রের অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ মিশকাত শরীফ! আমার প্রশ্ন হলো, যে শিক্ষার্থীরা নিজ থেকে একটা আরবি শব্দের তাহকীক করতে পারে না, নাহু-সরফের ব্যাসিক জ্ঞানটুকু পর্যন্ত যাদের নেই তারা কিভাবে নিজ থেকে তাফসীর এবং হাদীস বুঝতে সক্ষম হবে? কিন্তু তারপরও সিলেবাসভুক্ত হওয়ায় এবং পরীক্ষায় পাশ করার নিমিত্তে দায়সারাভাবে হলেও কিছু না বুঝে পড়া মুখস্থ করতে তারা বাধ্য হয়। কারণ যেকোনোভাবেই হোক, পরীক্ষায় পাশ করা লাগবেই। আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে নাহু-সরফ ও আরবি ভাষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর চেয়ে গণিত-ইংরেজি বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। ফলে আরবি বিষয়গুলো সিলেবাসভুক্ত কম্পালসোরি বিষয় হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের কাছে সেটা অপশনাল বিষয়ের মতোই বিবেচিত হয়।
যার ফলে নাহু-সরফ ও আরবি ভাষার জ্ঞান তাদের কাছে তেমন একটা মূল্য পায় না। অথচ একজন মাদরাসার শিক্ষার্থীকে আলেম হওয়ার জন্য যে মৌলিক গুণাবলি অর্জন করা দরকার তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নাহু-সরফের জ্ঞান রাখা এবং আরবি ভাষা সঠিকভাবে পড়তে ও বুঝতে পারা। কারণ, কোরআন, হাদীস ও ফিকহের মৌলিক সব গ্রন্থ আরবি ভাষায় রচিত। আর এই বিষয়গুলো বুঝতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষা জানা ও বোঝার মৌলিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কিন্তু তা আলিয়া মাদরাসা বিশেষ করে গ্রামের আলিয়া মাদরাসাগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে নেই।
যদি আমি সাহস করে বলি যে, ৯৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর মাঝেই নেই তাহলে আমার এই বলাটা অত্যুক্তি হবে না। অথচ কোরআন-হাদীস সঠিকভাবে বোঝার জন্য নাহু-সরফ ও আরবি ভাষা জানা মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যাবশ্যক। আর এর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন মনীষীগণ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন- ‘আরবি ভাষা দ্বীনের অঙ্গীভূত। কোরআন ও সুন্নাহ বোঝা ফরজ। আর আরবি জানা ছাড়া যেহেতু কুরআন-সুন্নাহ বোঝা সম্ভব নয়, তাই আরবি জানাও একটি আবশ্যকীয় ফরজ। ইসলামি আইনের একটি স্বীকৃত মূলনীতি হলো যা ছাড়া ওয়াজিব সম্পাদিত হবে না, তা-ও ওয়াজিব। অর্থাৎ ওয়াজিবের পূর্বশর্তও ওয়াজিব।’
কোরআন-হাদীস বোঝার জন্য নাহু-সরফ ও আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। অতএব, নাহু-সরফ ও আরবি ভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করা সত্ত্বেও যদি এদেশের অসংখ্য ফাজিল মাদরাসার কর্ণধার ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ পুরোপুরিভাবে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করে এই বিষয়গুলোর ওপর যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দেন এবং উক্ত বিষয়াবলি শেখার ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্বারোপ না করেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে গ্রামের আলিয়া মাদরাসা এবং এর শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। গতানুগতিক ধারায় এর কার্যক্রম চলতে থাকলে এবং এ ধারায় শত বছর পেরিয়ে গেলেও, আলিয়া মাদরাসা থেকে পড়াশোনা করে একজন যোগ্য আলেম বের হতে পারবে না।
তাই, আলিয়া মাদরাসাগুলোতে নাহু-সরফ ও আরবি ভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা এখন সময়ের দাবি। না হয় আলিয়া মাদরাসাগুলো ভবিষ্যতে তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে এবং যে মহৎ মাকসাদ নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সে মাকসাদ পূরণে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী: অনার্স ৩য় বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

