Logo

শিক্ষা

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই পরিবেশ সচেতনতা

Icon

আল ফয়সাল বিন কাশেম কানন

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৮

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই পরিবেশ সচেতনতা

বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক ও নৈতিক বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জীবনের প্রাথমিক ধাপেই গড়ে ওঠে তাদের চিন্তাভাবনা, আচরণ ও মূল্যবোধের বুনিয়াদ। শিক্ষাকে শুধু বইয়ের জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি প্রকৃতি, পরিবেশ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তবে তা শিশুদেরকে দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। 

প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবেশ সচেতনতা : প্রেক্ষাপট

পরিবেশ সচেতনতা বলতে বোঝায় মানুষের চারপাশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, তা রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি এবং ইতিবাচক মনোভাব ও আচরণ গড়ে তোলা। প্রাকৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ উপাদানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের কারণে বাংলাদেশ আজ এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের ভবিষ্যৎ তথা শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ-সচেতনতা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো সেই ক্ষেত্র যেখানে শিশুদের কচি মনে পরিবেশ-সচেতনতার বীজ রোপণ করা যায়। পাঠ্যেক্রমে পরিবেশ বিষয়ক ধারণা ও নৈতিকতা সংযোজন করলে তারা ছোট থেকেই প্রকৃতি ও জীবজগৎকে ভালোবাসতে শিখবে এবং পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ বিষয়ক বিষয়বস্তু, গল্প, কবিতা ও কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব।

শিক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ

পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট শিক্ষাদানকে বিশ্বজুড়েই একটি রূপান্তরমূলক হাতিয়ার বলে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিবেশগত সচেতনতা, জ্ঞান এবং দায়িত্বশীল আচরণ গড়ে তোলা যায়। ইবষমৎধফব ঈযধৎঃবৎ (১৯৭৫) এবং টঘঊঝঈঙ ঞনরষরংর উবপষধৎধঃরড়হ (১৯৭৭) অনুযায়ী, এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের পরিবেশের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ অনুধাবন, প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন এবং সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়া, ঝউএ-৪ (মানসম্পন্ন শিক্ষা) ও ঝউএ-১৩ (জলবায়ু কর্মসূচি)-এর মতো বৈশ্বিক ঐকমত্যগুলো টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বকে তুলে ধরে। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় পরিবেশ নীতিতে ‘শিক্ষা ও জনসচেতনতা’-কে একটি মূল ক্ষেত্র হিসেবে স্পষ্টভাবে উলে¬খ করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ‘পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা’। এর আওতায় পুরো শিক্ষা জাতীয় পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

পরে ২০২১-২০৩৬ সালের জাতীয় সংরক্ষণ কৌশলে সকল স্তরের পাঠ্যক্রমে পরিবেশ বিজ্ঞান ও টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনার ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২২ সালে ইউনেস্কোর গ্রিনিং এডুকেশন পার্টনারশিপ উদ্যোগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ বিদ্যালয়কে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘জলবায়ু সহনশীল করে প্রস্তুত’ করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়। এই নীতিগত কাঠামো গুলা প্রাথমিক স্তরে পরিবেশ বিষয়ের উপস্থিতির জন্য ভিত্তি গড়ে তোলে।

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে পরিবেশ সচেতনতা ধারণার উপস্থাপন

পরিবেশ সচেতনতা ধারণাকে শিক্ষার মাধ্যমে সঞ্চারণের উদ্দেশ্যে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ক্রমান্বয়ে প্রাথমিক পাঠ্যক্রম সংস্কার করেছে। ২০১৩ সালের পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোতে পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলো তুলনামূলক সীমিত ছিল; এটি সাধারণত বিজ্ঞান বিষয়টিতে একটি একক অধ্যায়েরমধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১০-এর দশকে এনসিটিবি বিষয়বস্তু হালনাগাদ করতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকগুলোতে (শ্রেণি ১-৫) পরিবেশ বিষয়বস্তু নিয়মিত অন্তর্ভুক্ত করে।

২০১৩ সাল থেকে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যক্রমে দুর্যোগ ও পরিবেশ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২১ সালের জাতীয় পাঠ্যক্রম কাঠামোতে ‘পরিবেশ ও জলবায়’ নামে একটি নতুন শিক্ষার ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা লাভের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়ার বৈচিত্র্য, গাছপালা ও পশুপাখির বাসস্থান, এবং বর্জ্যব্যবস্থাপনার ধারণা উঠে এসেছেবিভিন্ন পাঠে। চিত্র ও গল্পের মাধ্যমে ‘ডাস্টবিনে ময়লা ফেলা’, ‘প্লাস্টিক দূষণ’ও ‘গাছ লাগানো’ ইত্যাদি বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে।

পাশাপাশি জল, মাটি ও বায়ুর দূষণ, এর কারণ ও প্রভাব, নদীভাঙন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে ‘নদী দূষণ’, ‘প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ’ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা” বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউস প্রভাব এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে। পরিবেশের এই বহুমাত্রিক উপাদানগুলো শুধু বিজ্ঞান বইতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্যবইগুলোতেও পরিবেশ-সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে গল্প, উপমা ও উপদেশের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, পাঠ্যবইয়ে সরাসরি পাঠ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট ছোট পরীক্ষা, চিত্রায়ণ, বাস্তব জীবনের উদাহরণ এবং গ্রামীণ-নগর পরিবেশের তুলনা করে শেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি (২০১০) ও জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৩)-তে যে পরিবেশ শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সেই নীতির সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের সামঞ্জস্য আরও দৃঢ় করা গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে টেকসই জীবনযাত্রার মূল্যবোধ গড়ে তোলার কাজ আরও শক্তিশালী হবে। ফলে পরিবেশ শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে শিশুদের চিন্তাধারা ও আচরণেও গভীরভাবে প্রোথিত হতে পারবে, যা একটি পরিবেশ-সচেতন প্রজন্ম গঠনে কার্যকর অবদান রাখবে। তাই, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ বিষয়ক বিষয়বস্তুগুলো শিশুদের পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে ও দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। প্রাথমিক স্তরেই পরিবেশ-সচেতন নাগরিক তৈরি করার এ প্রয়াস, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য  প্রস্তুত করবে।

লেখক : সহকারী বিশেষজ্ঞ, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

প্রাথমিক শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর