বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কওমি মাদরাসা একটি প্রাচীন ও প্রভাবশালী ধারা। দেশের নৈতিক, ধর্মীয় ও প্রাত্যাহিক মূল্যবোধ গঠনে কওমি শিক্ষকরা বহু দশক ধরে নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- শিক্ষাসেবায় জীবনব্যাপী নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ কওমি মাদরাসা শিক্ষক বার্ধক্যে কোনো ধরনের আর্থিক নিরাপত্তা পান না। অবসর-পরবর্তী জীবনে তাঁদের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট ভাতা, নেই পেনশনের নিশ্চয়তা। এই অবহেলার অবসান ঘটাতে এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কওমি মাদরাসাগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে একটি স্থায়ী, টেকসই এবং ন্যায়সংগত পেনশন ব্যবস্থা তৈরি করা।
শিক্ষাসেবার প্রতি সম্মান
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্যান্য ধারায় শিক্ষকদের ন্যূনতম সুবিধা, চাকরির স্থায়িত্ব ও অবসর-পরবর্তী ভাতা নিশ্চিত থাকলেও কওমি শিক্ষকরা সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ তাঁদের অবদান সমাজের চরিত্র গঠনে অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় জ্ঞান এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষা-সবকিছুতেই কওমি শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাই কওমি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা কেবল মানবিকই নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বও বটে।
স্বনির্ভর পেনশন ব্যবস্থা
এই পেনশন প্রকল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে মাদরাসাগুলোর নিজস্ব তহবিল। বাহিরের ওপর নির্ভর না করে, কওমি ব্যবস্থার ঐতিহ্য অনুযায়ী স্বশাসিত মডেল বজায় রেখে একটি সংগঠিত ও স্বচ্ছ পেনশন কাঠামো তৈরি করা সম্ভব।
কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে?
কেন্দ্রীয় পেনশন ফান্ড গঠন : প্রতিটি মাদরাসা নির্দিষ্ট অনুপাতে তহবিলে অর্থ প্রদান করবে। সাথে থাকবে দাতব্য সংস্থা, ব্যক্তিগত অনুদান, ওয়াক্ফ ফান্ড ও মাদরাসার অন্যান্য আয়-সব মিলিয়ে একটি স্থায়ী ও নিরাপদ তহবিল গড়ে উঠবে।
নিয়মিত শিক্ষক অবদান : শিক্ষকরা স্বেচ্ছায় মাসিক অল্প পরিমাণ অর্থ জমা দিতে পারবেন। মাদরাসা প্রশাসন বা বোর্ডও তাদের একটি সমপরিমাণ বা নির্ধারিত অংশ যোগ করবে। এতে পেনশন হবে স্বনির্ভর এবং সময়ের সাথে বড় হবে।
ধাপে ধাপে অন্তর্ভুক্তি : প্রথমে বয়োবৃদ্ধ ও আর্থিকভাবে বিপন্ন শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে পরে ধীরে ধীরে সব শিক্ষককে এ সুবিধার আওতায় আনা যেতে পারে।
মাদরাসার আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি : বার্ষিক অডিট, খরচের স্বচ্ছতা এবং পেনশন ফান্ডের জন্য পৃথক হিসাবরক্ষণ এই ব্যবস্থাকে গণবিশ্বাস অর্জনে সহায়তা করবে।
পেনশনের উপকারিতা
স্বাধীনতা বজায় থাকে : রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা নির্ভরশীলতা ছাড়াই কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার স্বশাসিত কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকে।
দাতা ও সমাজের অংশগ্রহণ বাড়ে : মানুষ জানবে যে তাঁদের দান দীর্ঘমেয়াদি মানবিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিক্ষকদের মনোবল বৃদ্ধি পায় : পেশাকে সম্মানের চোখে দেখার প্রবণতা বাড়বে, তরুণরাও এই পেশায় উদ্বুদ্ধ হবে।
দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান : একবার তহবিল সংগঠিত হলে এটি বহু প্রজন্মের শিক্ষককে সহায়তা করতে সক্ষম হবে।
সমাজের নৈতিক দায়িত্ব
কওমি শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না; তাঁরা সমাজের বিবেক জাগ্রত রাখেন। তাঁদের বার্ধক্য যেন অনিশ্চয়তায় না কাটে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। মাদরাসার নিজস্ব তহবিল থেকে পেনশন চালুর উদ্যোগ কেবল একটি আর্থিক পদক্ষেপ নয়- এটি শিক্ষাসেবার প্রতি সম্মান, দায়িত্ববোধ এবং মানবিকতার একটি দৃষ্টান্ত।
কওমি মাদরাসায় নিজস্ব পেনশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি, মানবিকতার দাবি এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের দাবিও বটে। এখনই সময় মাদরাসার তহবিল ও সমাজের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি আধুনিক, স্বচ্ছ ও টেকসই পেনশন কাঠামো গড়ে তোলার। এতে শিক্ষকদের সম্মান রক্ষা হবে, শিক্ষা ব্যবস্থার মান বাড়বে এবং কওমি ঐতিহ্য আরও সুসংহত হবে বলে আশা করছি।
লেখক : প্রভাষক-ইসলামিক স্টাডিজ- দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা, পটুয়াখালী-বরিশাল

