আরবি ভাষা দিবস : ইতিহাস ও আমাদের করণীয়
মুহাম্মাদ তামিম বিন জামাল
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫১
আরবি ভাষা কোরআনের ভাষা, জান্নাতের ভাষা এবং মুসলমানদের ঈমান ও অনুভূতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি প্রায় ৩০টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। বিশ্বের বুকে আরবি ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম।
আরবি ভাষার স্বকীয়তা ও ঐতিহাসিক স্থায়িত্ব:
পৃথিবীর ইতিহাসে আরবি ভাষার পাশাপাশি অসংখ্য ভাষার জন্ম হয়েছে। কালের প্রবাহে অনেক ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে, আবার অনেক ভাষা তাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মধ্যেও আরবি ভাষা তার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখে আজও স্থিতিশীল ও গতিশীল অবস্থানে বিদ্যমান।
সময়ের পরিবর্তন কিংবা নতুন নতুন ভাষার আগমন- কোনোটিই আরবি ভাষার মৌলিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো, এই ভাষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে পবিত্র কোরআন। আল্লাহ তায়ালা কোরআনের হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং নিজেই গ্রহণ করেছেন- আর সেই হেফাজতের মাধ্যমে আরবি ভাষাও যুগের পর যুগ সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট:
অপরিসীম ঐতিহ্য, মর্যাদা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিসরে আরবি ভাষা দীর্ঘকাল উপেক্ষিত অবস্থায় ছিল। বৈশ্বিক সভা, সেমিনার ও অধিবেশনগুলোতে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার থাকলেও আরবি ভাষার জন্য কোনো স্বীকৃত স্থান নির্ধারিত ছিল না।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর এর দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি, ফ্রান্স, চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ- এই পাঁচটি ভাষা গৃহীত হয়। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরব জাতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আরবি ভাষাভাষীর বিপুল সংখ্যা থাকা সত্ত্বেও আরব নেতৃবৃন্দ নিজেদের মাতৃভাষায় বক্তব্য প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদেরকে বিদেশি ভাষায় বক্তব্য প্রদান ও তা শ্রবণ করতে বাধ্য হতে হতো। এমনকি দাপ্তরিক নথিপত্রও আরবি ভাষা থেকে অনুবাদ করে অন্যান্য দাপ্তরিক ভাষায় উপস্থাপন করতে হতো।
এই পরিস্থিতি আরব জাতির জন্য যেমন বেদনাদায়ক ছিল, তেমনি আরবি ভাষার মর্যাদার প্রতিও ছিল গভীর অবমাননাকর। বিষয়টি উপলব্ধি করেই আরব নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই এ বিষয়ে সচেতন ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সৌদি আরব ও মরক্কো সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরবি ভাষার অধিকার ও স্বীকৃতির বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন করে। ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আরবী অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে, ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা "ইউনেসকো" আরব দেশগুলোতে আরবী ভাষায় সভা, সেমিনার ও নথিপত্র আরবিতে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়।
১৯৬৬ সালে ইউনেসকোর সাধারণ সভায় ভিন্ন ভাষা থেকে আরবী এবং আরবী থেকে ভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৬৮ সালে আরবী ভাষাকে ইউনেসকোর সাধারণ সভা ও কর্মপরিষদের কার্যকরী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
১৯৭৩ সালে আরবী ভাষা জাতিসংঘ সাধারণ সভার মৌখিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং ২৮ তম অধিবেশনে দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের অক্টোবরে ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের ১৯০ তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়।
আরবী ভাষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব দেশ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর ধারাবাহিকতায় মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরবি ভাষা দিবস উদযাপন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও ১৮ ডিসেম্বর এ দিবস পালিত হয়। যদিও ১৮ ডিসেম্বর আরবি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, তবে আমাদের প্রিয় ভাষাকে শুধু একটি দিবসের সঙ্গে সীমাবদ্ধ না রেখে, তা প্রচার ও প্রসারে নতুন উদ্যমে এগিয়ে নেওয়াই হলো সময়ের দাবি। আরবি ভাষা সব সময় আমাদের কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে।
তাই আমাদের করণীয় হলো আরবি ভাষা শেখা, শেখানো এবং তার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় ভাষাকে সুরক্ষিত ও বিস্তৃত করা।
লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা বিভাগ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা

