ভাষার আলোয় সভ্যতার অভিযাত্রা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭
প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। এই দিবসের উদ্দেশ্য কেবল একটি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়; বরং আরবি ভাষার মাধ্যমে গড়ে ওঠা ইতিহাস, সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধকে স্মরণ করা। আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে যখন বহু ভাষা অস্তিত্ব সংকটে, তখন আরবি ভাষার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও প্রাণশক্তি নতুন করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আরবি ভাষার উৎপত্তি ও প্রাচীন ইতিহাস
আরবি ভাষা সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাচীন ভাষা। এর বিকাশ ঘটেছে আরব উপদ্বীপে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কেবল আঞ্চলিক ভাষা না থেকে বিশ্বভাষায় পরিণত হয়েছে। প্রাক-ইসলামি যুগেই আরবি ভাষা তার কাব্যিক সৌন্দর্য ও বাগ্মীতার জন্য পরিচিত ছিল। 'মুয়াল্লাকাত' নামে পরিচিত প্রাচীন আরবি কবিতাগুলো আজও ভাষাগত উৎকর্ষের অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
কোরআন ও আরবি ভাষার মর্যাদা
সপ্তম শতাব্দীতে পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মাধ্যমে আরবি ভাষা পায় এক অনন্য ও অতুলনীয় মর্যাদা। কোরআনের ভাষা হওয়ায় আরবি শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়; বরং তা বিশ্বাস, নৈতিকতা ও জীবনদর্শনের ধারক হয়ে ওঠে। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে আরবি ভাষার অবস্থান কেন্দ্রীয়। একই সঙ্গে কোরআনের ভাষাগত গভীরতা ও অলংকারশৈলী আরবি ভাষাকে দিয়েছে এক অতুলনীয় সাহিত্যিক মান। বাংলাদেশের খবর
ইসলামের বিস্তার ও আরবি ভাষার বিশ্বায়ন
ইসলামের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষা মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপের কিছু অংশ এবং এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে আরবি ভাষা কখনোই কেবল ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। প্রশাসন, আইন, শিক্ষা ও বাণিজ্যে এটি হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বহু অমুসলিম জনগোষ্ঠী ও চিন্তাবিদ আরবি ভাষা গ্রহণ করেন জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রয়োজনে।
আরবি সাহিত্য ও নান্দনিক ঐতিহ্য
আরবি ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধড়সব ক্ষেত্রেই আরবি সাহিত্য গভীর জীবনবোধ ও দর্শনের পরিচয় দেয়। আরবি ক্যালিগ্রাফি কেবল লিখনশৈলী নয়; এটি এক স্বতন্ত্র শিল্পরূপ, যা মসজিদ, স্থাপত্য ও চিত্রকলায় সৌন্দর্যের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভাষা ও শিল্পের এই মেলবন্ধন আরবি সভ্যতাকে দিয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশ ও আরবি ভাষার সম্পর্ক
বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আরবি ভাষার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ইসলামের আগমন, ধর্মীয় শিক্ষা ও মাদরাসা ব্যবস্থার মাধ্যমে আরবি ভাষা এ অঞ্চলে গভীরভাবে প্রোথিত। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশির জন্য আরবি ভাষা জীবিকা, যোগাযোগ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রধান মাধ্যম। তাই আরবি ভাষা শিক্ষা আজ কেবল ধর্মীয় প্রয়োজন নয়; এটি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বও বহন করে।
আধুনিক যুগে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ডিজিটাল যুগে আরবি ভাষা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও সম্ভাবনাও কম নয়। প্রযুক্তি, অনুবাদ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গবেষণায় আরবি ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। তবে প্রয়োজন আধুনিক পাঠক্রম, মানসম্মত গবেষণা এবং যুগোপযোগী ভাষাশিক্ষা ব্যবস্থা। আরবি ভাষাকে কেবল অতীতের ঐতিহ্য হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের কার্যকর ভাষা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-একটি ভাষা কিভাবে সভ্যতা নির্মাণ করে, জ্ঞানকে ধারণ করে এবং মানুষে মানুষে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। আরবি ভাষা কেবল আরব জাতির সম্পদ নয়; এটি বিশ্বমানবতার এক অমূল্য উত্তরাধিকার। এই দিবস উপলক্ষে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত- আরবি ভাষার মর্যাদা রক্ষা, এর চর্চা সম্প্রসারণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে তুলে ধরা।
লেখক : কলাম লেখক ও প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

