জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
বাংলা সিনেমার প্রথমআলো হীরালাল সেন

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৬:২৬

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যদি প্রথম আলো জ্বালানোর জন্য কারো নাম নিতে হয়, নিঃসন্দেহে সবার আগে আসবে হীরালাল সেন-এর নাম। তিনি শুধু বাংলা সিনেমার পথিকৃত নন, গোটা ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রথম ব্যক্তি। অনেকের চোখে তিনি ‘ভারতীয় সিনেমার অগ্রদূত’।
১৮৬৮ সালের ২ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হীরালাল সেন। তার বাবা মচীন্দ্রনাথ সেন ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ জেলাতেই শেষ করেন তিনি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য যান কলকাতায়, ভর্তি হন সিটি কলেজে। সেই সময়েই কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে নাটক, যাত্রা ও সাহিত্যের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় তার।
১৮৯৮ সালে কলকাতায় এসে প্রথম দেখা পান চলচ্চিত্রের জাদুতে। এ বছর প্যারিসের 'পাথে ফ্রেরেস স্টুডিও'র সদস্য অধ্যাপক স্টিভেনসনের একটি নাতিদীর্ঘ ছবি কলকাতার স্টার থিয়েটারে দেখানো হয়, The Flower of Persia (পারস্যের ফুল) নামে। পরে স্টিভেনসনের ক্যামেরা ধার করে নিয়ে হীরালাল বানান তার প্রথম ছবি ‘A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia’, ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য নিয়েই ছবিটি বানান। এরপর ভাই মতিলাল সেনের সাহায্যে লন্ডনের ওয়ারউইক ট্রেডিং কোম্পানির চার্লস আরবানের থেকে তিনি একটি ‘Urban Bioscope’ কিনে নেন। পরের বছর তিনি ভাইয়ের সাথে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির গোড়াপত্তন করেন।
এরপর তিনি ছোট ছোট সিনেমা বানাতে থাকেন। এসব ছিল চলচ্চিত্রে নাট্যাংশের চিত্রায়ন— ভারতে যেটা সেই সময় কেউ কল্পনাও করেনি। তিনি সিনেমা বানিয়েছেন যখন শব্দ ছিল না, স্টুডিও ছিল না, শুধু ছিল মনের আগুন।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে বলা যায়— হীরালাল সেন ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। যদিও তার কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল কলকাতা, কিন্তু তার জন্ম ও শিকড় বাংলাদেশেই। তাই তাকে শুধু ভারতের চলচ্চিত্রের নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসেরও গর্ব বলা যায়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, তার তৈরি প্রায় সব চলচ্চিত্র ১৯১৭ সালে একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাত্র কয়েকটি পোস্টার ও লিখিত নথি ছাড়া তার কাজের কোনো দৃশ্যমান দলিল আজ আর নেই। অথচ তিনি ২৭টিরও বেশি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন— তন্মধ্যে কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রও ছিল, যা ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞাপনেরও প্রথম প্রয়োগ বলে ধরা হয়।
হীরালাল সেন ছিলেন চুপচাপ, দৃঢ়চেতা মানুষ। একেবারে নিভৃতে কাজ করতে ভালোবাসতেন। তিনি কখনো খ্যাতির পেছনে ছোটেননি। তার জীবন শেষ হয় ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে।
হীরালাল সেন শুধু একজন নির্মাতা ছিলেন না— তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, যিনি সময়কে অনেক আগেই অতিক্রম করেছিলেন। যার অবদানকে আমরা সেভাবে সংরক্ষণ করতে পারিনি, কিন্তু তার নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
আজ, বাংলা চলচ্চিত্রের যে রঙিন দুনিয়া, তার প্রথম সাদা-কালো হাতছানি এসেছিল হীরালাল সেনের হাত ধরে। বাংলাদেশ ও ভারতের সিনেমা ইতিহাসে যদি কেউ সত্যিকারের ‘পথপ্রদর্শক’ হন, তবে তার নাম— হীরালাল সেন। তার জীবনকে জানার মধ্যে দিয়েই জানা যায়, সিনেমা শুধু বিনোদন নয়— সাহস, সময়চেতনা, ও স্বপ্নেরও নাম।