রাষ্ট্রীয়ভাবে নায়করাজের মরণোত্তর মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি : সম্রাট

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ২১:৫৫

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের কালজয়ী অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাককে হারানোর ৮ বছর পূর্ণ হলো আজ বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট)। ২০১৭ সালের এই দিনে ৭৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। প্রয়াণ দিবসে নায়করাজকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন নায়করাজের সন্তান চিত্রনায়ক খালিদ হোসেন সম্রাট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুদীপ্ত সাইদ খান।
বাংলাদেশের খবর : কেমন আছেন, দিনকাল কেমন কাটছে আপনার?
সম্রাট : আলহামদু লিল্লাহ। ভালো আছি।
বাংলাদেশের খবর : প্রায় আট বছর হলো প্রয়াত হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। ওনাকে কতটা মিস করছেন?
সম্রাট : এটা আপনি যে কোনও সন্তানকেই জিজ্ঞেস করেন, তার বাবা ইন্তেকাল করলে তারা কি পরিমাণ মিস করে- তো সবাই যেরকম করে আমরাও তাই করছি, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। সবার বাবা জন্মদাতা ইন্তেকাল করলে, চলে গেলে কেমন লাগে সন্তানদের- আমরা সেই ফিলিংসটাতেই আছি।
বাংলাদেশের খবর : উনি তো সাধারণ আট/দশজনের মতো ছিলেন না। উনি বাংলাদেশের সুপারস্টার ছিলেন, সেই জায়গা থেকে ওনার যে শূন্যতা সেটা পূরণীয় নয়। সন্তান হিসেবে সেই শূন্যতার অনুভূতিটা আসলে কেমন?
সম্রাট : সন্তান হিসেবে বললে, আমরা বাবাকে যেভাবে মিস করি এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা বাবাকে হারিয়েছেন তারা জানে কী হারিয়েছেন। আর আব্বার প্রফেশন বা তার উপাধি যেটা আছে, সেটা তো সবার জন্য, ওটা দেশের মানুষের জন্য, তার ভক্তদের জন্য, দর্শকের জন্য- এই শূন্যতা তারা উপলব্ধি করবে। আমি আশা করি- তারা বুঝতে পারবেন, তারা ফিল করেন। পার্সোনালি আমি তো আমার বাবাকে মিস করব। ডেফিনিটলি।
বাংলাদেশের খবর : এতদিন পরে আপনার বাবার কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বা এখন আপনাকে ভাবিয়ে তুলে?
সম্রাট : বাবা আমাকে ছাড়া খাওয়া দাওয়া করতেন না। তো প্রতিটা মূহূর্ত বাবার কথা মনে পড়ে। যেরকম সকালবেলা বের হবার আগে আব্বার সাথে কথা বলে, আব্বার সাথে নাস্তা করে বেরোতাম, দুপুরে কাজ শেষ করে সবার সাথে একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম। রাতের খাবার একসাথে খেতাম। প্রত্যেকটা মুহূর্তে বা বাবার যে কলগুলো আসত আমার কাছে- কোনও কাজের হোক বা আমি কোথায় আছি জানবার জন্য। আমি খাওয়া দাওয়া করেছি কিনা? তো এই জিনিসগুলো এখন খুব মনে পড়ে। বা আমি কোনও প্রব্লেমে পড়লে বা কোনও সাজেশন এর দরকার হলে যেরকম আমি ছুটে যেতাম বা আব্বাকে জিজ্ঞেস করতাম। আব্বার কিছু হলে আমি শুনতাম- আব্বা কোথায় যাবেন, কী করবেন। এগুলো আমার সাথে ডিসকাস করতেন। আবার তার মেডিকেলের ব্যাপারগুলো- যেমন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এগুলো বেসিক্যালি আমি আর আমার স্ত্রী দেখতাম। এই জিনিসগুলো আমরা আসলে এখন ফিল করি। এই জিনিসগুলো দেখভাল করতে চাইলেও এখন আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের খবর : নায়করাজের মৃত্যুর পর থেকে বিভিন্ন পত্রিকা বা গণমাধ্যম নানাভাবে ওনাকে স্মরণ করছে। ওনার সম্পর্কে ওনার ভক্তরাও জানতে চায়। আমরা শুনেছিলাম যে ওনার নামে একটা মেমোরিয়াল হবে বা ওনার আত্মজীবনী বের হবে। তো এই কাজগুলো মাঝখান থেকে হঠাৎ করে থেমে গেল। এই উদ্যোগগুলো থেমে যাওয়ার কারণ কি? বা আপনারা তাকে নিয়ে এরকম কাজ সামনে করবেন কিনা?
সম্রাট : এখানে ব্যাপার হচ্ছে কি দেখেন, জীবিতকালে আমি তো সব সময় আব্বার পাশেই বেশি থাকতাম। আব্বা নিজের ঢোল নিজে কখনো পেটাতেন না এবং উনি এই জিনিসগুলো অপছন্দ করতেন। নিজের ব্যাপারে বাড়িয়ে বলা পছন্দ করতেন না। এগুলোর মধ্যেই ছিলেন না এবং আমাদেরকেও বারণ করতেন।
উনি তো মহাতারকা ছিলেন। দেশের সম্পদ ছিলেন। তো এখন জাতীয়ভাবে যেটা হওয়া উচিত তার নামে- কোন মেমোরিয়াল করা বা কিছু একটা করা। আমি এটা বলছি না যে তার নামে মূর্তি বানানো হোক বা ওরকম কিছু- আমি ওগুলো বলছি না। আমি বলছি, তার উপর কাজগুলো জাতীয়ভাবে আসা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে তো আসলে দেখা যাচ্ছে, শিল্পীদের ওইভাবে সম্মান করা হচ্ছে না। উল্টো ডিসক্যারেজ করা হচ্ছে। এখন এটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে বা কারা করবে, কীভাবে করবে- আমরা আসলে এটা বুঝতে পারছি না বা সঠিক জানা নেই। কিন্তু জিনিসটা হল আপনি যদি কম্পেয়ার করেন- যে কোনও দেশের সাথেই করেন, শিল্পীদের মূল্যায়ন অন্যভাবে করা হয়। সে যে রকমের শিল্পীই হোক, আর্টিস্টদের একটু অন্যরকম ভ্যালু দেওয়া হয়। কারণ সবাই চাইলে আর্টিস্ট হতে পারে না। আবার আর্টিস্ট সাধারণের মতো হতে পারে না। এই কারণে এই জিনিসগুলো আসলে কারা ভাববে বা কারাই কাজগুলো এগিয়ে নেবে। আমরা আসলে বুঝছি না বা আমাদের সঠিক জানা নেই।
বাংলাদেশের খবর : বেসরকারি উদ্যোগে বা ব্যক্তি উদ্যোগে বা কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি এই এরকমের উদ্যোগ নেয়, সেক্ষেত্রে আপনাদের সহযোগিতা থাকবে কিনা বা আপনারা সেখানে ইনভলব হবেন কিনা?
সম্রাট : সেই উদ্যোগটাকে আগে দেখতে হবে। কী উদ্যোগ হবে? মানে সেটা কিসের উপরে করা হবে। ওনার উপরে তারা কী কাজ করবে?, আর্কাইভ করবে কিনা বা তার মেমোরিয়াল মানে তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কী কাজটা করবে- সেটা আগে দেখতে হবে। সেটা কোন পর্যায়ে তারা করবে বা সেটার কাজের মান কি হবে এটাও তো যাচাই বাছাই করতে হবে। আর যেহেতু একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তো থাকা উচিত। হ্যাঁ, ওই জিনিসগুলো- আসলে এটা তো শুধু আমাদের একার না। এখানে অনেকেরই তখন মতামত থাকবে। যাচাই-বাছাই হবে, তারপরে হবে। তো ওরকম ভালো কিছু হলে কেন থাকবো না। আমাদের কথা হচ্ছে- ভালো কিছু হোক, আব্বার উপরে কাজ হবে আব্বার পরবর্তীতেও অনেক তারকা শিল্পীরা ছিলেন, সম্মানীয় ব্যক্তিরা ছিলেন- তাদেরও উপরেও কাজ হোক। আমরা চাইবো যে আব্বার মতো গুণী মানুষ তো ১০০ বছরে একজন আসে, দুইজন আসে। তো এগুলো মূল্যায়ন করলে হয় কি- পরবর্তীতে একটা উদাহরণ হয়ে থাকে, এক্সাম্পল থাকে যে না এরকমভাবে তাকে মূল্যায়ন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের খবর : আপনি নিজেও তো অভিনয় করেছেন? চিত্রনায়ক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। এখন অনিয়মিত। নায়করাজের ছেলে হিসেবে বাবার ধারে-কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়তো হয় নাই। তো এই আক্ষেপটা কাজ করে কি না?
সম্রাট : আমার কোনও আক্ষেপ নেই। এই কারণে আক্ষেপ নেই- দেখেন আপনারা সবাই এই প্রশ্নটাই করে থাকেন যে, বাবার আশেপাশে যেতে পারো নাই- কিন্তু আপনারা একটা জিনিস কিন্তু কম্পেয়ার করছেন, উনি যে জেনারেশনে কাজ করেছেন বা যে প্রেক্ষাপটে কাজ করেছেন- ওই প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে কোনও নায়ক কাজ করতে পারেনি। তাহলে আরও অনেকেই নায়ক রাজ হতে পারতেন বা আরও অনেকে অনেক কিছু হতে পারতেন। তাই না! তো আমার আগে পিছেও কিন্তু অনেক অনেক আর্টিস্ট এসেছেন, ছেলেমেয়েরা কাজ করেছেন- তারাও কিন্তু এখন ইন্ডাস্ট্রিতে নেই। তো সবাই তো টার্গেট করবে যে না আমাকে একটা পজিশনে যেতে হবে। হ্যাঁ, সেটা এক নম্বর পজিশন, দুই নম্বর পজিশন হোক সেই জায়গাতে খেলতে হলে তো আপনার সেই ফিল্ডটা লাগবে। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যবশত সেই ফিল্ড পাই নাই। এমন এমন কাজের অফার আসত যেগুলো আমার নামের কারণে, আমার বাবার পরিচয়ের কারণে ওটা আমার জন্য বেরিয়ার হয়ে গিয়েছিল যে আমি এই কাজগুলো করব না। বা এই কাজগুলো আমার সাথেও যায় না। আমি যেভাবে পড়া লেখা করে বড় হয়েছি, যে ব্যাকগ্রাউন্ডে বড় হয়েছি। আমার সাথে এই কাজগুলো করা মানে আমার নিজেকে নিজে মানে ইনসাল্ট করার মতো হয়ে যায়। অনেক কাজ যেরকম ছেড়ে দিয়েছি। যে কয়েকটা কাজ করেছি এক্সপেরিয়েন্সের জন্য করেছি এবং করতে গিয়ে দেখেছি যে না এই কাজগুলো করে আসলে কিছুই করা যাবে না। এবং আল্টিমেটলি তাই হয়েছে। সেই ছবিগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সেই ছবিগুলো মানুষ দেখে নেই। কারণ কি? কনটেন্ট লাগবে? আর্টিস্ট ব্যাপার না, ব্যাপার হলো কনটেন্ট।আমরা যখন কাজ করেছি- এই সময় কোনও রকম ভালো কনটেন্ট হয় নাই। একই রকম ছবি আসছে যে, মায়ের জন্য হিরো কিডনি বিক্রি করছে, না হলে রক্ত দিচ্ছে- তো হাত ধরে পালস দেখে বলছে, ‘হ্যাঁ আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট’। তো তখন এরকম স্ক্রিনপ্লে হতো। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি ফিল করলাম যে, এইসব ছবি করে তো আমি নিজের নামও খারাপ করব। আমার বাবার নাম জড়িত আছে ওটাও খারাপভাবে দেখবে। মানুষ তাকে গালাগালি করবে, আমাকেও গালাগালি করবে। সময় থাকতে সুন্দর মতো হাত গুটিয়ে চলে আসছি। এই কারণে বললাম যে, আমার এখানে কোন আক্ষেপ নাই বরং আমার একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে। এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে এটা সুখকর ছিল না। মানে আমি কোন ক্রিয়েটিভ কাজ করার স্কোপ পাইনি। যে কয়েকটা পেয়েছি মোটামুটি ছিল বা দেখা যায় রিপিট কাজ হচ্ছে। বাট মূল জিনিসটা হচ্ছে না। এবং আল্টিমেটলি দেখেন- আমার সাথে যারা কাজ করছিল তারাও কিন্তু সাসটেইন করতে পারেনি। সবাই ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে চলে গেছে। তার মানে কি- ফিল্ড খারাপ ছিল?
যদি ফিল্ড ভালো থাকত, আমি যদি বাজে কাজ করতাম আমাকে বের করে দিতো, আমি চলে আসতাম। কিন্তু বাকিরা তো পারেনি। আর তুলনা হয় যেহেতু আমার বাবার নামটা বড়- এজন্য আমার তুলনাটা একটু বেশি হয়। এটাই। জেনারেলি এটাই হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের খবর : আপনাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেশি...
সম্রাট: হ্যাঁ, অনেক অনেক বেশি। যে নায়করাজ সাহেবের ছেলে এরকম কাজ করবে কিন্তু পরবর্তীতে এটা চিন্তা করে না যে- উনি যে প্রেক্ষাপটে কাজ করেছেন এখন তো ওই প্রেক্ষাপট নাই। বা ১০ বছর আগে এই প্রেক্ষাপট ছিল না। অশ্লীলতার একটা যুগে সিনেমা ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর যে কাজ করতাম- এমন এমন প্রোডিউসার আসতো ছবি বানাতে, যাদের সঙ্গে রুচির সাথে মিলত না। আমি কি কাজ করব? বেসিক্যালি টাকার জন্য তো সবাই কাজ করে না। নামের জন্য কাজ করে। হ্যাঁ, একটা ভালো কাজ করলাম- ওই হিসাবেই তো কাজে নেমেছি। পরে দেখলাম যে, না আসলে হবে না। এক্সপ্লয়েট করতে পারে না বা আর্টিস্টের পেমেন্ট ঠিক মতো দেয় না। এখনও কিন্তু এই ইস্যু নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। শিল্পীরা এখন মুখ খোলা শুরু করেছে, তারা পেমেন্ট পাচ্ছে না। যারা পারিশ্রমিক ঠিকমতো পায় না- এটা তো খুব খারাপ কথা। সবাই কষ্ট করে কাজ করে। যে রেমিউনেশন দেওয়া হয় তা দিয়েই অনেকের সংসার চলে। তো এরকম বাকি কত কত মানুষের পড়ে গেছে- অনেকেই টাকা পায় নাই। ওই যে দেখেন, আরও অনেক সিনিয়র শিল্পীদেরও নাম আসছে- চলচ্চিত্রে তাদের কত কত টাকা এখনও পাওনা। তো এইভাবেই চলে আসছে। আসলে তো খাপ খাওয়াতে পারি নাই। সবাই তো সবকিছু পারে না। আমিও পারি নাই। এজন্য আমি সুন্দরমতো চলে আসছি।
বাংলাদেশের খবর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
সম্রাট : আপনাকেও ধন্যবাদ। দোয়া করবেন সবাই আব্বার জন্য।