সাধারণ থেকে যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন জুবিন গার্গ

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:২৫

আজ আমরা এমন একজন সঙ্গীত শিল্পীর কথা বলব, যিনি শুধু একজন গায়ক ছিলেন না, ছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক আইকন – জুবিন গার্গ। আসামের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি কীভাবে ভারতের সঙ্গীত জগতে নিজের এক স্বতন্ত্র স্থান করে নিয়েছিলেন, আজ আমরা সেই গল্পই শুনব। তার কণ্ঠের জাদু, তার বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত এবং তার সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে করে তুলেছে এক কিংবদন্তি।
১৮ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে মেঘালয়ের তুরা-তে জুবিন বরঠাকুর (পরে জুবিন গার্গ নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল সাহিত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাঁর বাবা মোহিনী মোহন বরঠাকুর ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট, গীতিকার ও কবি, যিনি 'কাপিল ঠাকুর' ছদ্মনামে লিখতেন। আর মা ইলি বরঠাকুর ছিলেন একজন সুদক্ষ গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। মায়ের কাছেই মাত্র তিন বছর বয়সে জুবিনের সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। মায়ের তত্ত্বাবধানে তিনি সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ নেন এবং পরে গুরু রবিন ব্যানার্জীর কাছে তবলা ও গুরু রমণী রায়ের কাছে অসমীয়া লোকসঙ্গীতের তালিম নেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। স্কুলে পড়াকালীনই তিনি গান রচনা শুরু করেন এবং ১৯৯২ সালে একটি ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে ওয়েস্টার্ন সোলো পারফরম্যান্সে গোল্ড মেডেল জিতে নেন, যা তাঁকে পেশাগতভাবে সঙ্গীতকে বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করে।
১৯ বছর বয়সে, ১৯৯২ সালে জুবিন গার্গের প্রথম অসমীয়া অ্যালবাম 'অনামিকা' মুক্তি পায়। এই অ্যালবামটি উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অসমীয়া সঙ্গীত জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। 'মায়া', 'আশা', 'পাখি'র মতো একের পর এক সফল অ্যালবাম তাঁকে দ্রুত জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে আসে। ঐতিহ্যবাহী অসমীয়া সুরের সাথে আধুনিক সঙ্গীতের ফিউশন তাঁকে এনে দেয় এক ভিন্ন পরিচিতি।
১৯৯৫ সালে জুবিন মুম্বাইতে পাড়ি জমান বলিউডের সঙ্গীত জগতে কাজ করার উদ্দেশ্যে। বেশ কিছু হিন্দি অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রের জন্য গান রেকর্ড করলেও, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রেক আসে ২০০৬ সালে 'গ্যাংস্টার' ছবির 'ইয়া আলি' গানটির মাধ্যমে। এই গানটি সারা ভারতজুড়ে ঝড় তোলে এবং রাতারাতি জুবিনকে জাতীয় তারকায় পরিণত করে। 'ইয়া আলি' তাঁকে ২০০৬ সালে গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে সেরা প্লেব্যাক গায়কের সম্মান এনে দেয়। এরপর 'দিল তু হি বাত্তা' (কৃষ ৩), 'জানে কেয়া চাহে মন' (পেয়ার কে সাইড ইফেক্টস) এর মতো আরও অনেক হিট গান তিনি উপহার দেন।
জুবিন গার্গ শুধু একজন গায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, সঙ্গীত প্রযোজক, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও সফল হয়েছিলেন। তিনি ৪০টিরও বেশি ভাষা ও উপভাষায় প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন, যার মধ্যে অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি, নেপালি, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, ওড়িয়া এবং এমনকি বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষাও রয়েছে। তিনি ১২টিরও বেশি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন, যার মধ্যে তবলা, গিটার, ড্রামস, হারমোনিয়াম, দোতারা, ঢোল ও ম্যান্ডোলিন অন্যতম। তাঁর এই অসাধারণ প্রতিভা তাঁকে আসামের অন্যতম সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
সঙ্গীতের পাশাপাশি জুবিন চলচ্চিত্রেও অবদান রেখেছেন। ২০০০ সালে তিনি 'তুমি মোর মাথো মোর' ছবিতে অভিনয় ও পরিচালনা করেন। 'দীনবন্ধু' ছবির জন্য তিনি ২০০৫ সালে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও 'মন যায়', 'মিশন চায়না' ও 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'র মতো সফল ছবিতে তিনি কাজ করেছেন।
জুবিন গার্গ কেবল একজন শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। তিনি সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তা করা এবং আসামের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গীত ছিল আসামের পরিচয় ও আত্মার প্রতিচ্ছবি, যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সেতু তৈরি করেছিল। জুবিন গার্গ তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে কোটি মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
জুবিন গার্গের আকস্মিক প্রয়াণ সঙ্গীত জগতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে। তবে তাঁর গান, তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ক জীবন আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠা থাকলে যেকোনো সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।