Logo

বিনোদন

তাহসান আলাদা এবং একমাত্র

মোহাম্মদ নেসার

মোহাম্মদ নেসার

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৫

তাহসান আলাদা এবং একমাত্র

ছবি : বাংলাদেশের খবর গ্রাফিক্স

ঘরেতে এল না সে তো,

মনে তার নিত্য আসা যাওয়া।

মনে পড়ে লাইন গুলো? সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। মনের মানুষের সাথেই বিয়ে হচ্ছিল তার। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার কারণেই, ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায় বাঁশি কবিতার নায়ক। ভাবছেন তাহসানের গল্পে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আসছে কি কারণে? যৌক্তিক কারণ অবশ্যই আছে। পড়তে থাকুন বুঝতে পারবেন।

আসলে কলিজা লাগে। ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য তাকে ছেড়ে যেতে কলিজা লাগে। ঠিক তেমনি নিজের যে পরিচয় শিল্পী তৈরি করে। নিজের যে বিশেষণ সে গড়ে তুলে তাকে মুহূর্তে ঝেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কলিজা লাগে। সে কলিজা তাহসানের আছে, তাই সে পেরেছে। এ কারণেই নিজের যে মাপকাঠি সে নির্মাণ করেছে, সেখান থেকে তাকে কেউ কখনোই নামাতে পারবে না। আসুন খুঁজে দেখি কেন? 

প্রতিটি শিল্পীর নিজস্ব ফ্যানবেজ থাকে। তারাই শিল্পীকে-শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলে। এখানে আবার রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’ কবিতার লাইন টানা যায়, 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে'। এই 'আমি' আসলে শ্রোতা। সবই দর্শক-শ্রোতার চেতনার খেলা। একটি সস্তা কিন্তু সত্যি কথার প্রচলন আছে 'শিল্পী হয়ে কেউ  জন্মায় না, শিল্পী হয়ে ওঠে'। হ্যাঁ দর্শকের চেতনাই নির্ধারণ করে কে শিল্পী হবে কে হবে না। বিনোদন জগতে যে শিল্পী নিজস্বতা থেকে সরে গিয়েছে, তাঁর ভক্তরও তাকে ভুলে গিয়েছে। তাহসান নিজস্বতা থেকে সরে যায়নি, নিজে সরে গিয়েছে। এখানেই তাহসান আলাদা, এভাবেই তাহসান চিরস্থায়ী। 

৯০’র দশকের কয়েকজন দেশবরেণ্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যায়, পরবর্তীতে যারা শুধু এ্যালবাম বিক্রি বাড়ানোর জন্য নিজের স্পেশালিটি ধরে রাখতে পারেননি। আসুন নাম ধরে ধরে বলা যাক। 

আইয়ুব বাচ্চু-এলআরবি : তাঁর যারা ভক্তকুল আছেন তারা- চলো বদলে যাই, রূপালি গিটার, সেই তুমি, ফেরারি মনের মত গান শুনেই তাকে নির্বাচন করেছিল, তাঁর এ্যালবাম কিনেছিল বা কনসার্টে মেতেছিল। যখনই এবি তাঁর নিজস্বতা থেকে সরে এক চালা টিনের ঘর, উরাল দেব আকাশের মত গান গাইতে থাকল তখন থেকেই তাঁর ফ্যানবেজের চেতনায় ঘুণ ধরতে শুরু করলো। সে গান গুলো যে ভালো হয়নি, ঠিক তা না, তবে এটা আইয়ুব বাচ্চুর নিজস্বতার সাথে যায় না। তাই সেই এক চালা টিনের ঘরে তাঁর  মূল ভক্তরা থাকেনি। যদিও পরে তিনি কষ্টটা একটু কম দিলে, সাবিত্রী রায়ের মত কিছু গান গেয়ে তাঁর  জনরায় ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্মম ভক্তরা তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তখন থেকেই শিল্পী বাচ্চুর মৃত্যুর সূচনা হয়েছিল।  

হাসান-আর্ক : ব্যান্ডসঙ্গীত পাড়ায় প্রচলিত আছে যে, হাসানের মত সকল স্কেলে সুরে গাওয়ার ব্যান্ড শিল্পী দ্বিতীয় জন নেই। প্রথমে কপিয়ার এ্যালবামে কপি গান দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও পরে- যারে যা উড়ে যা, সুইটি, প্রশ্ন, বাংলাদেশ, এত কষ্ট কেন ভালবাসায় গেয়ে নিজস্বতা তৈরি করেছিলেন হাসান। শেষমেশ তিনিও ভিখারিদের থিম সং 'আমার আল্লাহ নবীজির নাম' এর মত গানে মুভ করে নিজের কফিনে শেষ পেরেকটি পুতে দিয়েছিলেন। এর ফল ভালো হয়নি। যিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারতেন তিনি অতীত হয়ে পড়ে রইলেন। নিজস্বতা থেকে সরে সুফল পাননি হাসানও।

বিপ্লব-প্রমিথিউস :  যিনি গেয়েছেন 'মনের পাল উরাইয়া দিও, দুঃখ পেলে একা কাঁদো, ওগো মা তুমি কেঁদোনা'র মত গান তিনিই আবার এক একে এক, ঝিলিক মারিস না মাইয়ারে'র মত ক্লিশে গান গেয়ে তাঁর নিজস্ব শ্রোতাকে ধোঁকা দিয়েছেন। তাই টিকে থাকতে পারেননি।

এমন আরো অনেক উদাহরণ তুলে ধরা সম্ভব। বেশি লিখলে বিরক্তি বাড়বে। লেখার একটা পরিমিতিবোধ থাকা উচিৎ।

হ্যাঁ পরিমিতিবোধ, শিল্পগুণ, রুচিশীলতা এগুলোই শিল্পের মাপকাঠি। এই মাপকাঠি ছাড়া শুধু জনপ্রিয়তা হল ব্যবসা, শিল্প নয়। আমাদের যে শিল্পীরা শুধু ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, ঝুঁকতে ঝুঁকতে একদিন তারা পড়ে গিয়েছিলেন। তাহসান ঝুঁকে ঝুঁকে ঝরে পড়তে চায়নি বলেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আপনি যদি ইউটিউবে যান, ব্লাক, অর্থহীন, আর্টসেল, শিরোনামহীনের যেকোনো গানের পাশে হালের কিছু ক্রিঞ্জ গানের ভিডিও চালিয়ে দেখবেন। কোনটার ভিউ বেশি? আমি লিখব না । আপনারাই মিলিয়ে নেবেন।

এখানে কাউকে ছোট করা হচ্ছে না, শিল্প সার্বজনীন। যে কেউ চাইলেই শিল্পী হতে পারে। তাঁরও নিজস্ব দর্শক থাকতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে শিল্পের মানদণ্ডে সেই শিল্প পরিমাপ যোগ্য হতে হবে, শুধু ভিউ দিয়ে মান বিচার করা যায় না। হিরো আলমের গানের উদাহরণ কি এখানে লেখার দরকার আছে? 

এই যে- “যে কেউ চাইলেই  শিল্পী হতে পারে” এটিই শিল্পের সর্বনাশের সবচেয়ে বড় কারণ। কিন্তু আমরা বিষয়টা খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছি। এটাকে তুলনা করুন যে- “যে কেউ চাইলেই ডাক্তার হতে পারে” তখন মনে হবে কি সর্বনাশের কথা। ভাই শিল্পীতো ডাক্তারই তাইনা। গান কি মুড পরিবর্তন করে না, মন ভাল করে দেয় না, আবেগে তাড়না জাগায় না, সমাজ পরিবর্তন করে না, যুদ্ধ থামিয়ে দেয় না? দেয়।   

অন্য ভাবেও বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ চাইলেই নির্বাচন করতে পারে।  কিন্তু কথা হল সে নেতার রুচিবোধে যদি সমস্যা থাকে তাহলে তিনি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবেন সে নজির আমরা দেখেছি বহুবার। 

আইয়ুব বাচ্চু, হাসান বিপ্লবের মতো অনেক শিল্পীই বড় পরিসরে দর্শক পাওয়ার জন্য জেনেশুনে নিজের শিল্প সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে, এক একে এক করে আল্লাহ নবীজির নামে এক চালা টিনের ঘর তৈরি করেছিলেন, সে ঘর টেকেনি। সে ঘরের খুঁটি শক্ত ছিল না। তারা ভেঙ্গে পড়েছে, ঝড়ে পড়েছে। তাহসান সে কম্প্রোমাইজটা করেননি। তাই তিনি সঙ্গীত থেকে বিদায় নিয়েও রয়ে গেলেন চিরকাল।

শুধু ব্লাকের তাহসান না, মাইলসের সাফিন, হামিন, ফিডব্যাকের মাক্সুদ, নোভার ফজল, শিরোনামহীন, অর্থহীন, আর্টসেল এমন অনেক নাম বলা যাবে। যারা নিরবে এই “যে কেউ পারের” ভিড় থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। পার্থক্য শুধু এটুকুই, তাহসান সাহস করে ঘোষণা দিয়ে ছেড়েছে, বাকিরা ছেড়েছে নিরবে। এখানেও তাহসান আলাদা এবং একমাত্র।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বিনোদন বাংলা গান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর