৫ আগস্ট ২০২৪। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী সমর্থক অনেক তারকাকে দেওয়া হয় ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা। তাদের অনেকেই চলে যান আড়ালে, কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশেও।
বিনোদন দুনিয়ায় আলোচিত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা পাওয়া তারকাদের নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে আলোচনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই তারকারা এখন রয়েছেন নাজুক অবস্থায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একসময় রাজনৈতিক সভা-মঞ্চে নিয়মিত উপস্থিতি ও প্রচারাভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন তারকা বর্তমানে পর্দার আড়ালে চলে গেছেন। কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমিত উপস্থিতি বজায় রাখছেন। অন্যদিকে, কয়েকজন আবার অভিনয় বা ব্যক্তিগত ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, কোন তারকারা ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন-
জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থী ও সারা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শোবিজ তারকারাও যখন রাজপথে নেমে এসেছিলেন, ঠিক তখন শোবিজে দেখা যায় বিভক্তি। শিল্পীদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে থাকলেও, আরেক দল শেখ হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি শিল্পীদের একাংশ। বিটিভিতে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে চব্বিশের ১ আগস্ট বিটিভি প্রাঙ্গণে হাজির হন সংস্কৃতি অঙ্গনের আওয়ামীপন্থি একঝাঁক তারকাশিল্পী। তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা ফেরদৌস, রিয়াজ, আজিজুল হাকিম, অভিনেত্রী নিপুণ, সোহানা সাবা, রোকেয়া প্রাচী, জ্যোতিকা জ্যোতি, নূনা আফরোজ, কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব, নির্মাতা এসএ হক অলীক, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুসহ আরও অনেকে। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড। অগ্নিকাণ্ডে বিটিভির ক্ষয়ক্ষতি দেখে তাদের অনেকে অঝোরে কেঁদেওছিলেন। এর আগেও শেখ হাসিনার সমর্থনে বিটিভি ভবন পরিদর্শন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সারা যাকের, পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, ঝুনা চৌধুরী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ প্রমুখ।
তাদের এই কান্না নিয়ে সেসময় প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল, যা এখনো চলমান রয়েছে। গণঅভ্যত্থানের স্বপক্ষের লোকজন তাদেরকে ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিয়ে বলতে থাকে, ‘নিহত ছাত্র-জনতার জন্য তাদের চোখে কোনো পানি ছিল না। তাদের চোখের পানি গড়িয়েছে ইট-পাথরের দেওয়ালের জন্য।’
শুধু তাই নয়, আওয়ামীপন্থি সেসব শিল্পী খুলেছিলেন ‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। এ গ্রুপে দুই শতাধিক সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন। যারা জুলাই বিপ্লবের পুরোটা সময় শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছেন। সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী আরাফাতের সমন্বয়ে এ গ্রুপের অ্যাডমিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ, রিয়াজ, সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী শামীমা তুষ্টি। গ্রুপের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, তানভীন সুইটি, জ্যোতিকা জ্যোতি, রোকেয়া প্রাচী, সোহানা সাবা, সুবর্ণা মুস্তাফা, বিজরী বরকতুল্লাহ, স্বাগতা, শমী কায়সার, আশনা হাবীব ভাবনা, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, হৃদি হক, দীপান্বিতা মার্টিন, নূনা আফরোজ, মেহের আফরোজ শাওন, সঙ্গীতা মেখাল, শাহনূর, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, রওনক হাসান, জামশেদ শামীম, খান জেহাদ, ফজলুর রহমান বাবু, আশরাফ কবীর, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, ঝুনা চৌধুরী, লিয়াকত আলী লাকি, সাইফ খান, স্মরণ সাহা, সায়েম সামাদ, মিলন ভট্ট, নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদ, মাসুদ পথিক, জুয়েল মাহমুদ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, এসএ হক অলীক প্রমুখ। এদের মধ্যে অনেকেই এখনো ফেসবুকে সক্রিয়ভাবে ও প্রকাশ্যে জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন।

অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি অভিনেতা আহসান হাবিব নাসিম ও সাধারণ সম্পাদক অভিনেতা রওনক হাসান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হচ্ছে, এমন দাবি করে বিবৃতি দিয়ে প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ছাড়া অনেকেই শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘এক দফা দাবি মানি না’ বলেও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।

এ ছাড়া আন্দোলনে বেশ কিছু তারকাশিল্পী ছিলেন নীরব ভূমিকায়। এর মধ্যে রয়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, মীর সাব্বির ও অভিনেত্রী তারিন জাহানও, নুসরাত ফারিয়া তো স্বয়ং হাসিনার রূপেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ তালিকায় ছিলেন চিত্রনায়ক আরেফিন শুভও।
চলুন, এবার জেনে নেওয়া যাক- ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা পাওয়া এই তারকারা এখন কে কোথায় রয়েছেন-
আওয়ামীপন্থী বেশিরভাগ তারকায় এখন রয়েছেন অনেকটা আত্মগোপনে। কেউ কেউ চুপি চুপি কাজও করছেন। আবার অনেকেই ইতোমধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। দুয়েকজনকে যেতে হয়েছে জেল হাজতেও।

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক ফেরদৌস ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। অপর দিকে জায়েদ খান পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকায়।

শুধু জায়েদ খান নয়, আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন চিত্রনায়ক সাইমন সাদিক, মাহিয়া মাহি, পিকলু খান, এসএহ হক অলিকসহ আরও বেশ কয়েকজন তারকা।

চিত্রনায়িকা নিপুণ রয়েছেন দেশেই। মাঝে বিদেশে পাড়ি জমাতে চাইলেও বিমান বন্দরে তাকে আটকে দেওয়া হয়। শেষে ফিরে আসেন।

রোকেয়া প্রাচী দেশেই রয়েছেন- শুধু তাই নয়, আবির্ভূত হয়েছেন সাহসী নারীর ভূমিকায়। রোকেয়া প্রাচী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে সোচ্চার রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সমালোচনাও করে থাকেন তিনি।

এদিকে ‘মুজিব: একটি জাতির রুপকার’ সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করা নুসরাত ফারিয়াকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, আলো আসবেই গ্রুপের সোহানা সাবা ও মেহের আফরোজ শাওনকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। দুজনেই এখন ঢাকায় রয়েছেন।

সাবা ও শাওন দুজনেই নানা অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভুমিকা পালন করছেন।

অপরদিকে অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিকে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন দেশেই অবস্থান করছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম দেশেই ছিলেন। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাসমাবেশে সক্রিয় ছিলেন চিত্রনায়ক রিয়াজ। গত বছরের ৭ আগস্ট তিনি বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়, এমন একটি প্রতিবেদন সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি রিয়াজকে। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন- জানা যায়নি কিছুই। একটি বিশেষ সূত্রের খবর, রিয়াজ ঢাকাতেই আছেন। তবে প্রকাশ্যে আসছেন না।

‘আলো আসবেই’ গ্রুপে যুক্ত ছিলেন চিত্রনায়িকা অরুণা বিশ্বাস। আর সেখানে তার পরামর্শ ছিলো, ছাত্রদের ওপর গরম পানি ছিটানোর। এসব কথার স্ক্রিনশট ভাইরাল হলে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয় অভিনেত্রীকে ঘিরে। এরপর দেশের পট পরিবর্তন হলে গোপনে কানাডা পাড়ি দেন অরুণা বিশ্বাস- এমনই খবর মেলে। এখন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করছেন বিতর্কিত এই অভিনেত্রী। জানা গেছে, বহু বছর আগে থেকেই তিনি কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সেখানে শুধু তিনি একাই নন, তার মা, ছেলে, ভাই ও তার পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী উর্মিলা শ্রাবন্তী কর। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ও গ্রেফতারকৃত সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে উর্মিলার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পর থেকে উর্মিলা শ্রাবন্তী কর আত্মগোপনে রয়েছেন এবং তার মোবাইল ফোন বন্ধ আছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার। ছিলেন ই-ক্যাবের সভাপতিও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর রাতে উত্তরার বাসা থেকে আটক করা হয় শমী কায়সারকে। গত ১১ আগস্ট হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়। এখন দেশেই রয়েছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেত্রী ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন জাহান। সরকার পতনের পর থেকেই আড়ালে রয়েছেন তিনি। খবর রয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেশ থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। যদিও অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন তারিন। অভিনেত্রীর অবস্থান নিশ্চিত না হওয়া গেলেও নিয়মিত ফেসবুকে সরব তিনি। প্রতিনিয়ত সরকারবিরোধী পোস্ট করেন নিজের ফেসবুকে।

‘মুজিব-একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে চিত্রনায়ক আরিফিন শুভও বনে যান ফ্যাসিস্টের দোসর। তিনি দেশেই রয়েছেন, কাজও করছেন। তবে তার পূর্বাচলের সরকারি বরাদ্দের প্লটটি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
আওয়ামী ঘরানার অনেক জনপ্রিয় তারকা দেশে থাকলেও ইদানিং কাজ পাচ্ছেন না তারা। রাজনৈতিক কারণে অনেক জনপ্রিয় তারকা কোণঠাসা হওয়ায় অনেকটাই থমকে গেছে শোবিজ অঙ্গন। অনেকেই মন্তব্য করেছেন— তারকাদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া ঠিক নয়। তবে যেটাই হোক না কেন, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সবার অংশগ্রহণে আবারও চাঙা হয়ে উঠুক শোবিজ অঙ্গন— এমনটাই প্রত্যাশা বিনোদনপ্রেমীদের।
এসএসকে/


