Logo

প্রবাস

‘ধার করা’ বিলাসিতায় দাঁড়িয়ে মালদ্বীপের উন্নয়ন

Icon

সিপন চন্দ্র মন্ডল

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৯

‘ধার করা’ বিলাসিতায় দাঁড়িয়ে মালদ্বীপের উন্নয়ন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

বিগত কয়েক দশকে মালদ্বীপবাসীর জীবনযাত্রায় বিপুল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। যা দেখে মনে হতেই পারে এ পরিবর্তন জীবনমানকে অনেক উন্নত করেছে কিন্তু গভীরেভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, এই তথাকথিত উন্নতি মূলত ধার করা বিলাসিতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। 

দুঃখজনকভাবে, যে ঝকঝকে জীবনধারা ও মূল্যবান জিনিসপত্র মানুষ প্রদর্শন করে, সেগুলোর অধিকাংশই প্রকৃত উপার্জনের ফল নয় বরং ঋণের টাকায় কেনা, যা পরিশোধ করতে মাস বা বছর লেগে যায়। এই ঋণের মেয়াদ ছয় মাস থেকে শুরু করে ২০ বছর পর্যন্তও হতে পারে। ফলে অনেকেই একসাথে একাধিক ঋণ নিচ্ছেন। কর্মীদের বেতনের বিপরীতে সহজে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ই এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করছে। ফলে “ঋণনির্ভর জীবনযাপন” এখন সমাজে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

ঋণের শৃঙ্খল বনাম জীবনের মান
দেশের অর্থনৈতিক সংকট সরাসরি প্রভাব ফেলছে জনগণের জীবনমানে। ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার খরচ ইতিমধ্যেই মালদ্বীপবাসীর কাঁধে ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু এ কঠিন বাস্তবতার মাঝেও ধনী-গরিব নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষ ঋণের মাধ্যমে “আরামদায়ক জীবন” গড়ার প্রলোভনে নিজেদের আরো আর্থিক বন্ধনে জড়িয়ে ফেলছেন।

জীবনযাত্রার ঋণ, ভোগ্যপণ্য ও শিক্ষা 
মালদ্বীপে ব্যক্তিগত ঋণের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পারিবারিক ঋণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ঋণই জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও আধুনিক ভোগ সংস্কৃতির প্রতিফলন, যাকে বলা যায় “চকচকে আধুনিকতার ঝিলিক”।

মালদ্বীপ মানিটারি অথরিটির (এমএমএ) তথ্য বলছে, ব্যক্তিগত ঋণের একটি বড় অংশই যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের জন্য।

এই ঋণগুলো প্রয়োজনের চেয়ে বিলাসিতার প্রতীক; নতুন গাড়ি, বড় ইলেকট্রনিক পণ্য বা দামি আসবাব কেনার জন্য নেওয়া ঋণগুলো তা-ই প্রমাণ করে। এইসব ক্রয় সাময়িক আনন্দ দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ভবিষ্যতের আয়ের উপর আগাম বন্ধক।

তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন সহজেই এ প্রলোভনে পড়ছেন। ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ক্রেডিট স্কিমে কিনছেন, যা কয়েক মাস সঞ্চয় করেই ক্রয় করা যেত। তারা বুঝতেই পারছেন না এ ঋণ চক্র দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎকে সংকটে ফেলছে।

শিক্ষা ঋণ বিনিয়োগ না বোঝা
শিক্ষা ঋণ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ যা উচ্চশিক্ষার সুযোগ এনে দেয় এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়ায়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি তৈরি করে এক ভারী আর্থিক দায়। ঋণের কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী বাধ্য হচ্ছেন এমন চাকরি নিতে যা তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রের সঙ্গে মেলে না, শুধু ঋণ শোধ করার তাগিদে।

বিয়ে ও ছুটির জন্য ঋণ
সম্প্রতি বিয়ে ও ছুটির ঋণও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের ঋণ সাধারণত “ব্যক্তিগত ঋণ”র অংশ হিসেবেই দেখা যায়।

বিলাসবহুল বিয়ে অনুষ্ঠান বা বিদেশ ভ্রমণের খরচ মেটাতে অনেকেই এখন ঋণ নিচ্ছেন যা সমাজে মর্যাদা বজায় রাখার এক নতুন মানদণ্ড হয়ে উঠেছে।

ফ্লাই নাও, পে লেটার এ ধরনের স্কিমগুলো এখন সাধারণ হয়ে গেছে যা ভ্রমণকে প্রয়োজন নয়, বরং সামাজিক মর্যাদার প্রতীক বানিয়ে তুলেছে। ফলে মালদ্বীপে ঋণ নেওয়া এখন কেবল প্রয়োজনের জন্য নয়, আনন্দ ও মর্যাদার জন্যও এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে

পারিবারিক ঋণের ক্রমবর্ধমান বোঝা
গত দশকে মালদ্বীপে ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এমএমএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যেখানে ওডিসি (Other Depository Corporations) থেকে নেওয়া ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ ছিলো ৭.২৫ বিলিয়ন মালদ্বীপ রুপিয়া সেখানে ২০২৫ সালের আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৮.১২ বিলিয়নে।

২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটি একটানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যা দেখায় যে, গৃহস্থালিরা ক্রমেই ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।

এই ঋণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ একদিকে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে এটি প্রকাশ করে সাধারণ নাগরিকের ক্রমবর্ধমান আর্থিক দুর্বলতা।

উচ্চ ব্যয়, কম সঞ্চয়
আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে মালদ্বীপে জীবনযাত্রার খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। খাবার, জ্বালানি থেকে শুরু করে রাজধানী মালেতে বাসাভাড়া সবকিছুই নাগরিকদের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত ঋণ নিচ্ছেন, এমনকি দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসের জন্যও।

এই অবস্থায় পরিবারের আয়ের বড় অংশ ঋণ পরিশোধেই চলে যায়, সঞ্চয়ের সুযোগ প্রায় থাকে না।

অর্থাৎ মানুষ এখন ঋণ শোধ করতেই বাঁচছে সঞ্চয় বা আর্থিক নিরাপত্তা গড়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে।

এই ধারাবাহিক ঋণচক্র মানুষকে স্থায়ী আর্থিক চাপে রাখছে, যা পরিবারগুলোর মানসিক শান্তি ও জীবনের মান উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ঋণ-জিডিপি অনুপাত এক উদ্বেগজনক সূচক
২০২৪ সালের হিসাবে মালদ্বীপের পারিবারিক ঋণ ও জিডিপি অনুপাত প্রায় ১৭.১ শতাংশ।

২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা বেড়ে ১৭.৯ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, জাতীয় অর্থনীতির একটি ক্রমবর্ধমান অংশ এখন সাধারণ মানুষের ঋণের বোঝায় জড়িয়ে পড়ছে।

২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রবণতা আজ মালদ্বীপের আর্থিক স্থিতি ও নাগরিকদের জীবনমান উভয়ের জন্যই এক গুরুতর সতর্ক সংকেত।

  • এমআই
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর