রাজশাহীর ঢোপকল : জলসভ্যতার প্রত্নস্মারক
ইতিহাস, প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যের মিলনস্থল
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৩
-680b20ecdce8b.jpg)
ব্রিটিশ ভারতে নগর সুবিধার আদি-উদ্যোগগুলির মধ্যে রাজশাহীর ‘ঢোপকল’ এক অনন্য নিদর্শন। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন রাজশাহী নবাব পরিবারের মহারানি হেমন্ত কুমারী চন্দ্রাবতীর অর্থায়নে নির্মিত এই জলসরবরাহ ব্যবস্থা আজ দাঁড়িয়ে আছে অবহেলা আর সংরক্ষণের দাবির মাঝামাঝি এক প্রত্ন-প্রযুক্তির সাক্ষী হয়ে।
ঐতিহাসিক পটভূমি : কেন তৈরি হয়েছিল ঢোপকল?
১৯৩০-এর দশকে রাজশাহী শহরে পানীয় জলের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। গঙ্গা নদীর দূষিত পানি ও কূপের অপ্রতুলতা নিয়ে প্রকাশিত ‘দ্য রিপোর্ট অন ওয়াটার সাপ্লাই ইন রাজশাহী’ (১৯৩৫)-এ ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সতর্ক করে দেয় : ‘এখানকার ৮০ শতাংশ নাগরিক ডায়রিয়া ও কলেরার শিকার হচ্ছে অপরিশোধিত পানি পান করে।’
এই সংকটে এগিয়ে আসেন মহারানি হেমন্ত কুমারী। নবাব পরিবারের আর্কাইভ থেকে পাওয়া নথি থেকে জানা যায়, তিনি ১.২ লাখ টাকা দান করেন (যার বর্তমান মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা), সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার যোগ করে ৪০ হাজার টাকা। প্রকল্পের নকশা করেন ইঞ্জিনিয়ার জে.এইচ. গ্রেটহেড (পরবর্তীতে যিনি করাচি বন্দরের নকশাকার)।
প্রযুক্তির বিস্ময় : কীভাবে কাজ করত ঢোপকল?
পদ্মা নদীর গতিপথ অনুসরণ করে ১৫০ ফুট গভীরে স্থাপন করা হয় বিশেষ ফিল্টারযুক্ত কূপ। প্রাথমিকভাবে কয়লা চালিত বাষ্প ইঞ্জিন দিয়ে পানি তোলা হতো, যা পরে বিদ্যুৎচালিত হয় (১৯৫২ সালে)। পরবর্তী সময়ে টিনের পাইপ (বর্তমানে আইরন পাইপ) দিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছাত পানি। এটি ছিল বাংলার প্রথম ‘পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই’।
হেরিটেজ হিসেবে গুরুত্ব
ঢোপকলের মূল পাম্প হাউসটি নির্মিত হয়েছিল ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যে, যার গম্বুজ আজও দৃশ্যমান। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ‘প্রথম গ্র্যাভিটি-ফিড ওয়াটার সিস্টেম’—পরে লাহোর ও কলকাতায় এই মডেল অনুকরণ করা হয়। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে ঢোপকল থেকে বিনামূল্যে পানি বিতরণ করা হয়েছিল, যা স্থানীয় ইতিহাসে উল্লেখ আছে ‘পানির রেশনিং’ নামে।
কী অবস্থায় আছে ঢোপকল?
২০০১ সালে সিটি কর্পোরেশন ‘আধুনিকীকরণ’-এর নামে ভেঙে ফেলা হয়েছে মূল পাম্প হাউসের ৬০ শতাংশ। ২০১৫ সালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (RDA) প্রকল্পের জায়গায় শপিং কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা করে, যা স্থানীয় প্রতিবাদের মুখে বাতিল হয়। তবে বর্তমানে মাত্র ১২টি মূল নলকূপ সচল, যেগুলোতে দূষণের মাত্রা WHO-এর মানদণ্ডের চেয়ে ৩ গুণ বেশি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা, ২০২৩)।
এদিকে নগরীর কিছু পয়েন্টে এখনো রানি হেমন্ত কুমারীর রেখে যাওয়া ঢোলকল সচল রয়েছে। যেটি স্থানীয়দের পানির মূল উৎস। নিত্যদিনের সকল কাজ এই পানি দিয়ে করা হয়ে থাকে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ : আশার আলো
২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঢোপকলকে ‘শিল্প ঐতিহ্য’ তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। স্থানীয় সংগঠকরা প্রতি বছর ১৯ জুন (প্রতিষ্ঠা দিবস) ‘ঢোপকল বাঁচাও আন্দোলন’ পালন করে থাকে। স্থানীয়ভাবেও সামাজিক ও সিটি করপোরেশনের যৌথ সহযোগিতায় এটিকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
কিউরেটর সাদিয়া মিজান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ঢোপকল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। রানি হেমন্ত কুমারী রেখে যাওয়া পানির উৎসবটি বিলুপ্তির পথে। একে সংরক্ষণ করতে কর্তৃপক্ষ, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, ফিল্ম মেকার, ব্লগার, মিডিয়া ও সচেতন নাগরিক সকলকে এক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই একে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
এদিকে রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের ডেপুটি চিফ কনজার্ভেশন কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস (অবসরপ্রাপ্ত) জানান, এটা সংরক্ষণ করা জরুরি দরকার। এটি পাবলিকলি ব্যবহার অনুপযোগী হয়েছে নানা কারণে। তাই এটার ব্যবহার নিয়মাবলি আধুনিক করতে হবে। একই স্ট্রাকচার ব্যবহার করে এর আধুনিকায়ন করলে রানি হেমন্ত কুমারীর রেখে যাওয়া প্রথম সুপেয় পানির যে ধারা যেটি টিকে থাকবে। এটি ইতিহাসের সাথে পূর্ণ যোগসূত্র রয়েছে। গ্রাম বাংলার এমন সকল ইতিহার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব বলে আমি মনে করে। তবে কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন হয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. পারভেজ মামুদ বলেন, ওয়াস যেহেতু সুপেয় পানি জন্য কাজ করছে তাই এটাকে টিকিয়ে রাখা আমাদেরও দায়িত্ব। আর রানি হেমন্ত কুমারী প্রথম সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। অবশ্যই এটিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমরা ওয়াসার পক্ষ থেকে এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সার্বিক সহযোগিতা করবো যেন এর পানি ব্যবহার উপযোগী হয়।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে রাজশাহী দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আতিকুর রহমান আতিক। তিনি বাংলাদেশের বলেন, ঢোপকল রাজশাহী শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এগুলো রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। উন্নয়নের নামে, সড়ক প্রশস্ত করণের নামে এই ঐতিহ্যগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এক সময়ের এই যুগান্তকারী প্রাণ বাঁচানো ঢোপকলগুলো উপস্থাপনের জন্য নগরীর অবশিষ্ট ঢোপকলগুলো অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা অতীব জরুরি। শুধুমাত্র যাদুঘরে নয় ঢোপকলগুলো যেটি যে অবস্থানে রয়েছে সেখানেই সেটিকে সংরক্ষণের অন্যতম ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সেখানেই সেগুলো সংরক্ষণ ও সম্ভব হলে চালু করতে হবে।
তিনি বলেন, ঢোপকল কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি নারী উদ্যোগেরও প্রতীক। মহারানি হেমন্ত কুমারী প্রমাণ করেছিলেন, নারীরা কীভাবে জনকল্যাণমূলক অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেন।
৭৫ বছর বয়সী রিকশাচালক আব্দুল মজিদ বলেন, আমার শৈশবে এখানকার পানি এতই পরিষ্কার ছিল যে ডাক্তাররা পেটের রোগীদের এখানকার পানি পান করতে বলতেন। এখন তা শুধু স্মৃতি।
স্থানীয়রা ও বিজ্ঞরা বলছেন, ঢোপকলের ইট-পাথরে লেখা আছে এক যুগের গল্প। যেখানে প্রযুক্তি, জনদরদি রাজনীতি ও নারী নেতৃত্ব মিলেমিশে একাকার। এই ধ্বংসস্তূপকে রক্ষা করা মানে শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং বাংলাদেশের নগর সভ্যতার জন্মইতিহাসকে সম্মান দেওয়া।
জেসি/এমএইচএস