জল, জীবিকা ও জীবনের গল্প জমানো পাত্র ‘মাটির কলসি’
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ০৯:১৪

তীব্র রোদের সময়ে এক ঢোক পানি হয়ে ওঠে পরম স্বস্তি। আর এই স্বস্তি ধারণের এক আদি-পাত্র মাটির কলসি। তবে কেবল পানি ধরে রাখার পাত্র হিসেবে নয়—এটি যেন ঐতিহ্য আর জীবনের হাজোরো গল্পের আধার হয়ে টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী পল্লিতে এই মাটির কলসিগুলো সংস্কৃতি, স্মৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক সূত্র বহন করে চলেছে। রাজশাহী, চাঁপাই, রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার মাল পাহাড়িয়া, সাঁওতাল, মাহালী, ওঁরাও, কোল, রাজোয়ার—প্রতিটি সম্প্রদায়ের জীবনধারায় এই পাত্র জড়িয়ে আছে নিত্য ব্যবহারে, আচার-অনুষ্ঠানে, এমনকি লোককথা হয়েও। তাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক জীবনের অংশ হয়ে আছে মাটির কলসি।
মাটির এই পাত্র শুধু ঠান্ডা জল দেয় না, বরং জমানো থাকে তাতে শতাব্দীজুড়ে টিকে থাকা টেকসই জীবনের অনুপম নিদর্শন। আধুনিকতার ঢেউয়ে প্লাস্টিক যখন গ্রাস করছে আমাদের গৃহস্থালি, তখনও গ্রামীণ নারীর কাঁখে কলসি তুলে পুকুরঘাটে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য অন্তরঙ্গ ছবি হয়ে রয়ে যায় বাংলার মাটি ও মননে। মাটির কলসি—যা জল রাখে, জীবন বাঁচায়, আর নিঃশব্দে জমায় সমাজের অসংখ্য ইতিহাস।
মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মাটির কলসির ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০-৪০০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা, মিশর ও মেসোপটেমিয়ায় মাটির পাত্রের প্রচলন ছিল। বাংলাদেশ, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় এটি কৃষি ও গৃহস্থালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গ্রামীণ সংস্কৃতি ও আদিবাসী গোষ্ঠীভেদে মাটির কলসির ব্যবহার
মাল পাহাড়িয়া সম্প্রদায় : ‘মাটির হাঁড়ি’কে মাল পাহাড়িয়ারা ‘কাঁড়ষা’ বলে থাকেন তাদের নিজস্ব ভাষায়। এটি তারা ব্যবহার করেন পানি সংরক্ষণ ও ঠান্ডা রাখার কাজে। একই সাথে ধান ও শস্য সংরক্ষণের জন্য মাটির বড় পাত্র (কাঁড়ষা) ব্যবহার হয়। গরমে মাটির কলসির পানি তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে বলে বাংলাদেশের খবরকে জানান রঞ্জিত সাউরিয়া (পাহাড়িয়া)।
সাঁওতাল সম্প্রদায় : এই জাতি গোষ্ঠীর সকলে মাটির হাড়িকে/কলসিকে নিজস্ব ভাষায় ‘কান্ডা’ বলে থাকে। এটি তারা তাদের কৃষ্টিগত নানা কার্যক্রমে ব্যবহার করে থাকে। হাঁড়িয়া (চালের মদ) রাখার জন্য মাটির তৈরি বিশেষ কলসি ব্যবহার করা হয়। গ্রীষ্মে পানি ঠান্ডা রাখতে রোদে ভেজা মাটি দলা করে চাক বানিয়ে তা দিয়ে কলসি ঢেকে রাখে। একই সাথে বিবাহ অনুষ্ঠানে কলসি ভাঙার রীতি (টুকুই ভাঙ্গা) রয়েছে।
মাহালী সম্প্রদায় : স্থানীয় নাম ‘কুলহাঁড়ি’ ঠিলি, ’হাসা কান্ডা’। মাহালী সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা বাঁশের কুঁড়ে ঘরে কলসি ঝুলিয়ে রাখে যাতে পানি ঠান্ডা থাকে। আলু, পেঁয়াজ, ভুট্টা ও ধান সংরক্ষণের জন্য মাটির কলসি ব্যবহার করে এই জনগোষ্ঠী।
ওঁরাও সম্প্রদায় : ‘গেইলা’ মূলত ওঁরাওরা যে কলসি ব্যবহার করে তাকে বলে। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, উৎসব পার্বণে ঐহিত্যগত ভাবে এই গেইলা ব্যবহার করে। এই জাতি গ্রীষ্মে কলসির গায়ে কাপড় জড়িয়ে পানি ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করে।
কোল সম্প্রদায় : স্থানীয় নাম ‘মুগ্রো’। তারা পানি ছাড়াও দুধ ও তরকারি রাখার জন্য ব্যবহার করে। একই সাথে তারা মাটির কলসিতে ভাত রেখে গরম রাখে।
রাজোয়ার সম্প্রদায় : ‘গামলা’ এই জাতির নিজস্ব কৃষ্টিগত নাম। পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি মাটির কলসিতে মোরগ-মুরগির খাবার দেওয়া কাজে তারা ব্যবহার করে। একই সাথে শীতকালে গরম পানি রাখার জন্যও তারা গামলা ব্যবহার করে।
মাটির কলসি নিয়ে নানা অঞ্চলে ও নানা সংস্কৃতিতে রয়েছে বৈচিত্র্যময় নাম এবং ব্যবহার। গ্রামবাংলায় নারীরা পুকুরে যখন কলসি নিয়ে পানি নিতে যায় সেই দৃশ্য দেখে মন ছুঁয়ে যাবে যে কারো।
এই দৃশ্যকে কবিতার ছন্দে লিখলে হয়—
ঝাঁ-ঝাঁ রোদে পোড়া মাঠে,
একটি কলসি দাঁড়িয়ে আছে-
গায়ে তার ফাটল ধরা,
তবু ঠায় অবিচল।
কুমারপাড়ার শেষ চাকাটি
বন্ধ হলো গত বছর,
রিকশা চালায় মাধব দাস
যে ছিল এ গ্রামের সেরা কুমোর।
গ্রামের বুড়িরা এখনো বলে,
‘প্লাস্টিকের বোতলের জল
মাটির ঘড়ার মতো ঠান্ডা হয় না...’
কিন্তু কে শোনে তাদের কথা?
বর্ষায় ভিজে ফুলে ওঠে,
গ্রীষ্মে ফাটল ধরে,
তবুও রান্নাঘরের কোণে
টিকে আছে একাই-
এক নিষ্ঠুর সময়ের বিরুদ্ধে
লড়াই করে যাওয়া
এক নীরব সৈনিকের মতো।
মাঝে মাঝে বিকেলবেলা
কোনো অতিথি এলে
মা তাড়াতাড়ি তুলে আনে
ধুলো মাখা কলসিটা-
‘এখনো আছে আমাদের ঘরে
একটুকু ঠান্ডা জল...’
বলে হাসেন লজ্জা নিয়ে,
যেন কোন অপরাধ করেছে!
গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে মাটির কলসি শুধু একটি পাত্র নয়, এটি সামাজিক রীতির অংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ হারে। প্রাকৃতিক ফ্রিজ হিসেবে গ্রাম বাংলায় মাটির কলসির গুরুত্ব বেড়েছে। এটি ব্যবহারে কিছু গুণাগুণ হলো :
১. প্রাকৃতিক কুলিং সিস্টেম : মাটির ছিদ্র দিয়ে পানি বাষ্পীভূত হয়ে ঠান্ডা হয়।
২. স্বাস্থ্যসম্মত : প্লাস্টিকের BPA মুক্ত, তাই নিরাপদ।
৩. স্থানীয় অর্থনীতির চালিকা : কুমারদের আয়ের উৎস।
৪. পরিবেশবান্ধব : প্লাস্টিক দূষণ কমায়।
তীব্র রোদে মাটির কলসির ব্যবহারের কৌশল
উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা গরমে মাটির কলসির কার্যকারিতা বাড়াতে নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করে :
১. ভেজা কাপড় জড়ানো : কলসির গায়ে ভেজা মোটা কাপড় পেঁচিয়ে রাখে, যা বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানি ঠান্ডা করে।
২. ছায়ায় রাখা : কলসিকে বাঁশের মাচার নিচে বা গাছের ছায়ায় রাখে।
৩. বালি ব্যবহার : কলসির চারপাশে ভেজা বালি দিয়ে ঢেকে রাখে, যা প্রাকৃতিক কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করে।
৪. দুই স্তরের কলসি : বড় কলসির ভেতরে ছোট কলসি রেখে মধ্যবর্তী স্থানে ভেজা বালু দেয়, যা পানি দ্রুত ঠান্ডা করে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সংরক্ষণের প্রয়োজন
কুমার পেশার অবলুপ্তি : গ্রামবাংলায় যারা কুমার পেশাকে ধারণ করতো তারা এখন সময়ের সাথে সেই জায়গা থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে এই কুমারা হারিয়ে যেতে বসেছে। একই সাথে স্বল্প লাভজনক তাই এই পেশায় মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে।
প্লাস্টিকের আগ্রাসন : সস্তা প্লাস্টিকের পাত্রের কারণে মাটির কলসির চাহিদা কমছে।
এই সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে গুণিজন বলছেন :
- স্থানীয়ভাবে মাটির কলসির উৎপাদন বৃদ্ধি।
- আদিবাসী হাটে মাটির পাত্রের বিক্রয় কেন্দ্র তৈরি।
- সরকারি ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
মাটির কলসি শুধু একটি ব্যবহার্য পাত্র নয়, এটি আদিবাসী সংস্কৃতি, গ্রামীণ ঐতিহ্য ও টেকসই জীবনের প্রতীক। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের জীবনধারায় মাটির কলসি একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাধান। তীব্র গ্রীষ্মে এর ব্যবহার শুধু প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, বরং বর্তমান জলবায়ু সংকটে একটি প্রয়োজনীয় অভ্যাস হতে পারে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় সম্প্রদায় ও সরকারের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। একই সাথে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই প্রাচীন শিল্প আবারও ফিরে আসতে পারে।