
মহিউদ্দিন খান খোকন
৩১ মে ২০০৭। দুপুর দেড়টায় নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। হংকং থেকে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের বিশাল উড়োজাহাজে দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার একটানা ভ্রমণ শেষে আমেরিকায় আগমন— যা ছিল আমার জীবনের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমেরিকা পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে স্বপ্নের দেশ, কেউ কেউ একে বলেন স্বর্গের দুয়ার। সেই প্রতীক্ষিত স্বর্গের দুয়ারেই আজ আমি এসে দাঁড়ালাম।
‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকার জাতিসংঘ ভবনের সামনে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে প্রতি বছরই দিনটি পালন করে আসছে। তারা প্রতি বছরই আয়োজন করে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবের। এবার উৎসবটির পরিসর আরও বড় করা হয়েছে— চারটি স্টেটে: নিউ ইয়র্ক, টেক্সাসের ডালাস, ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস এবং নিউ জার্সি। উৎসবটি ২০০৭ সালের ১ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহা বাংলাদেশ থেকে অনেককে এই আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। আমাকেও একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠান। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত ড. আনিসুজ্জামান, তরুণ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, খ্যাতনামা লেখিকা রাবেয়া খাতুন, ‘বাংলার গান’খ্যাত গায়ক মাহমুদুজ্জামান বাবু, আ কদ্দুস বয়াতি এবং সমসাময়িক সময়ে খুব জনপ্রিয় গায়ক হাবিব ওয়াহিদ ও ফেরদৌস ওয়াহিদ। আমি ছিলাম এই পুরো ইভেন্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে।
এই আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবে ডেলিগেট হিসেবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকেই মনে ভীষণ রকম উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এশিয়া মহাদেশের প্রায় সব দেশেই আমি এর আগেই সফর করেছি, কিন্তু আমেরিকার বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। হয়তো একসময় যেতামই, কিন্তু এমন আকস্মিক আমন্ত্রণে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস ছিল অসাধারণ।
তবে আমেরিকা ভ্রমণের প্রথম শর্ত হলো— ভিসা। আমার পাসপোর্টে বহু দেশের ভিসা থাকলেও, আমেরিকার ভিসা পাওয়াটাকে সহজভাবে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। যদি না পাই— এই আশঙ্কায় কাউকে কিছু জানাইনি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে ভিসা আবেদন জমা দিলাম। মাত্র তিন দিনের মধ্যে ইন্টারভিউয়ের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হলো।
নির্ধারিত দিনে, যথারীতি আমেরিকান দূতাবাসে হাজির হলাম। ভিসা ইন্টারভিউয়ের অপেক্ষায় অনেকে বসে আছেন— মুখে চিন্তার ছাপ। সবার বুকেই দুরুদুরু— ‘ভিসা কি মিলবে?’ আমি বসার কিছুক্ষণ পরই একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। এক নারী, যার মেয়ে আমেরিকায় অসুস্থ, মেয়েকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে রিফিউজ করা হয়েছে। তিনি বেরিয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিষয়টি দেখে মন খারাপ হয়ে গেল।
অবশেষে আমার ডাক পড়ল। প্রথমে পাসপোর্ট জমা দিলাম, আঙুলের ছাপ দিলাম, তারপর অপেক্ষা ইন্টারভিউয়ের। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ডাক এল। কাঁচের জানালার ওপাশে লাল চুল, লাল দাড়িওয়ালা এক তরুণ অফিসার। তিনি হ্যালো বললেন। আমিও হাসিমুখে হাই বললাম। অফিসারের হাতে আমার পাসপোর্ট।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমেরিকায় কেন যাচ্ছেন? কতদিন থাকবেন?’— সাধারণ প্রশ্ন। আমি উত্তর দিলাম। তিনি আমার কোম্পানির কাগজপত্র দেখতে চাইলেন— দিয়ে দিলাম। খুব দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখলেন এবং কম্পিউটারে দ্রুত কিছু টাইপ করলেন। আমি তখন হৃৎকম্পন নিয়ে অপেক্ষা করছি— কী হবে? ভিসা কি মিলবে?
অফিসার মুখ তুলে হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন এবং যে কথাটি বললেন তা হলো— ‘ইউ আর কোয়ালিফাইড ফর মাল্টিপল ভিসা, প্লিজ কালেক্ট ইয়োর পাসপোর্ট উইথ ভিসা ডে আফটার টুমোরো। থ্যাংক ইউ, হ্যাভ এ গুড ডে।’
আমি মহাখুশি হয়ে অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভিসা পেয়েছি, তাও আবার মাল্টিপল ভিসা। আগামী এক বছর যতবার খুশি আমেরিকা যেতে পারবো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
আমেরিকা যাবার পথে হংকং হয়ে যাবো বলে সবার আগেই রওনা হলাম। ২৬ তারিখ রাতে বাংলাদেশ থেকে ড্রাগন এয়ারে উড়াল দিলাম। ২৭ তারিখ ভোরে হংকং পৌঁছলাম। ছোট ভাই দুলু আমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এসেছিল। ওর সাথে সাম সুই পো’র বাসায় গেলাম। মোমেনা, সেতু মনি, তাসিন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল— সবাই খুব খুশি। হংকংয়ে আমরা চার দিন থাকলাম।
৩১ তারিখ সকালে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের বিমানে চড়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। টানা ১৪ ঘণ্টা কীভাবে কাটাবো— ভাবছিলাম, সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ও ছিল মনে। বাস্তবে যা ঘটলো তা হলো—
উড়োজাহাজে উঠে এয়ার হোস্টেসদের হাসিমুখে আমন্ত্রণে সিটে বসলাম। গান শোনা, মুভি দেখা, খেলা এবং বই পড়ার ব্যবস্থা দেখে অল্প সময়েই ঘণ্টা দুই কেটে গেল। আমার জন্য আগে থেকেই অর্ডার দেওয়া মুসলিম ফুডও সরবরাহ করলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে খেয়ে নিয়েছিলাম, সময় কাটানো ছাড়া কাজ ছিল না। খেয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম আসছিল না।
এয়ারফোন কান থেকে লাগিয়ে অডিও চ্যানেলগুলো ঘুরে দেখলাম। (প্রত্যেক সিটের হাতলেই আছে অডিও ও ভিডিও চ্যানেলের বাটন। ইচ্ছেমতো গান শোনা যায় এবং সামনের স্ক্রিনে মুভি দেখা যায়।) হঠাৎ করেই একটি হিন্দি গান চ্যানেল পেয়ে গেলাম। পুরোনো ও নতুন অনেক গান বাজছিল, খুব ভালো লাগলো। অনেকক্ষণ গান শুনে কাটালাম। ভিডিও চ্যানেলে সব ইংরেজি সিনেমা টিপে টিপে দেখলাম এবং স্থির হলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর একটি মুভিতে।
চমৎকার এক ছবি ছিল— এক ইংরেজ লোক তার নিগ্রো গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে পালাচ্ছে। গুলি, শেল, বোমা, আগুন আর লাশের মধ্যে এক বিধ্বস্ত ঘরের ভাঙা দেয়ালের আড়ালে প্রসব বেদনায় কাতরানো স্ত্রীকে নিয়ে ভয়াবহ উত্তেজনার মধ্যে সন্তানের জন্ম। তারপর আর্মিদের নজরে পড়া, প্রসূতি ও সদ্যজন্মা শিশুর প্রতি মমতা ও সম্মান, ক্ষণিকের জন্য থেমে যাওয়া যুদ্ধগোলা, গুলি বন্ধ এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আবার যুদ্ধ। এক ভয়ের ছায়া মাখানো শ্বাসরুদ্ধকর ছবি। প্রায় দু’ ঘণ্টার সিনেমা শেষ হলো।
প্লেনে ওঠার পর এতো কিছু করেও মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পার করতে পেরেছি। বাকি ৯ ঘণ্টা কীভাবে কাটাবো ভাবছি। গায়ে কম্বল টেনে পা দুটো সামনের আসনের নিচে লম্বা করে মেলে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঢাকার কথা মনে পড়ছে, নিজের বিছানার কথা মনে পড়ছে। নানা আবেগ-উদ্বেগ মাথায় ভিড় করছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। একটানা গোঁ গোঁ শব্দ, আরাম পাচ্ছি না।
আমার এক বন্ধু রাবু, যিনি লন্ডনে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে বড় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন, বর্তমানে যোগ্যতায় ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কর্মরত। বিশ্বজুড়ে তার কাজ, বিভিন্ন দেশে প্লেনে ভ্রমণ করতে হয়। আমেরিকা যাত্রার আগে তাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম কীভাবে দীর্ঘ জার্নি পার করবো। রাবু বলেছিল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সময় দ্রুত কেটে যাবে। তার উপদেশ ছিল— হালকা, ঢোলা ও আরামদায়ক পোশাক পড়তে হবে, অর্থাৎ কমফোর্টেবল ড্রেস। টাই-কোট বা স্যুট ঠিক হবে না। চাইলে লুঙ্গিও পরা যায়।
সাথে নিতে হবে হালকা কোনো উপন্যাস, আর প্লেনে প্রচুর লিকুইড খেতে হবে— যেমন ফলের জুস, বিয়ার বা ওয়াইন (যদি অভ্যাস থাকে)। কারণ দীর্ঘ উড়োজাহাজ যাত্রায় শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়। আমি তার উপদেশ মতোই কমফোর্টেবল পোশাক পরেছি। প্লেনে ওঠার পর থেকেই কমলার জুস খাচ্ছি, পানি তো অবশ্যই।
আসনের হাতলে আছে কলিং লাইট সুইচ। সুইচ টিপলেই মাথার ওপর ছোট্ট হলুদ বাতি জ্বলে ওঠে। এয়ার হোস্টেস সেই লাইট দেখেই ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে— ‘আপনি কী চাইবেন?’ আমি বলি, ‘জুস, পানি বা চা-কফি।’ এক মিনিটের মধ্যে তা নিয়ে আসে।
এক সময় পায়ের জুতো খুলে আরাম করে বসে আছি।
প্লেনে ওঠার পর এয়ার হোস্টেস প্রত্যেক যাত্রীকে দিয়েছে একটি এয়ারফোন সেট, একটি কম্বল প্যাকেট এবং একটি ছোট্ট, সুন্দর হলুদ চেইন লাগানো ব্যাগ। ব্যাগটি খুলে দেখি এর মধ্যে রয়েছে এক জোড়া মোজা, একটি টুথব্রাশ, ছোট্ট একটি টুথপেস্টের টিউব, এবং একটি প্যাকেট বাদাম।
জুতা খুলে সেই মোজা জোড়া পরে নিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে তলপেট ভারী হয়ে গেছে। লিক্যুইড যা খেয়েছি সব গিয়ে জমেছে, এখন জলবিয়োগ করার দরকার। পাশের সিটে থাকা মহিলাকে ইশারা করলাম, ‘টয়লেটে যাচ্ছি।’ তিনি সিট ছেড়ে উঠে আমাকে বের হওয়ার সুযোগ দিলেন।
জুতা পরতে গিয়ে দেখি, পা ফুলে যাওয়ার কারণে জুতায় পা ঢুকছে না। তাই জুতা না পরে শুধু মোজা পড়ে টয়লেটে গেলাম।
দু’সারি আসনের মাঝে লম্বা চলার পথ। উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেঁটে বেশ ভালো লাগলো। এয়ার হোস্টেস আগেই বলেছিল, সারাক্ষণ বসে না থেকে মাঝে মাঝে হাঁটতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে, অরাম করতে হবে। আমি তাই করলাম।
প্লেনের ফ্রেশ রুমটি ছোট্ট, কিন্তু চমৎকার। এই ছোট্ট পরিসরেই অনেক ব্যবস্থা আছে— ঠান্ডা ও গরম পানি, লিকুইড সাবান দিয়ে ভালো করে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ব্যবস্থা, দু’ধরনের টিস্যু পেপার, মুখ মোছার জন্য লোশন এবং হাত মাখার জন্য আলাদা লোশন।
জলবিয়োগ করে তলপেট হালকা করলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে এসব ব্যবহার করে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। প্যাসেজ ধরে এদিক ওদিক দু’বার হাঁটলাম। যাত্রীরা বেশির ভাগই ঘুমোচ্ছে, কেউ ছবি দেখছে, কেউ বই পড়ছে, কেউবা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। পুরো প্লেনজুড়ে আবছা অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এরপর আবার নিজের সিটে বসে পড়লাম।
আমাদের প্লেনটি ২২,০০০ ফুট উচ্চতায় থেকে ৫৭০ মাইল বেগে প্যাসিফিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে টিভি স্ক্রিনে ক্যাপ্টেন এই ফিচারগুলো দেখায়— প্লেনের ভেতর ও বাইরে তাপমাত্রার তথ্য ইত্যাদি।
সুদীর্ঘ, ক্লান্তিকর সময় কাটানোর বর্ণনাও ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। পরের ঘন্টাগুলো কীভাবে কাটিয়েছি, কী করেছি— সেগুলোও বর্ণনা করা ভারি হয়ে যাচ্ছে।
ঘুম, কিংবা ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা, বই পড়া, গান শোনা, ছবি দেখা এবং নানা রকম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পার করেছি দীর্ঘ সময়।
প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের প্লেন নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে অবতরণ করবে।
সারাবোর্ডে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল, আড় মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে, বিশাল প্লেনটির চাকা আমেরিকার মাটি স্পর্শ করল। জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে প্লেনটি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বোর্ডিং ব্রিজে দাঁড়ালো।
বোর্ডিং ব্রিজ পেরিয়ে এয়ারপোর্টের বিশাল লাউঞ্জে ঢুকলাম। মোটেই পছন্দ হলো না পুরোনো, পচা এয়ারপোর্ট ভবন। আমি হংকং, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট দেখেছি—কী সুন্দর ঝকঝকে, অত্যাধুনিক আর আমেরিকান একটা এয়ারপোর্ট, আর এর এই অবস্থা! পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এটি অনেক দিনের পুরোনো এয়ারপোর্ট; আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে যখন তৈরি হয়েছিল, তখন হয়ত এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক এয়ারপোর্ট। সুতরাং আধুনিক এয়ারপোর্ট হংকং, ব্যাংকক এসবের সঙ্গে এর তুলনা করা ঠিক হবে না।
বেশ কিছু দূর হেঁটে এসে ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ লাইন, তবে অনেকগুলো ডেস্ক থাকায় সময় বেশি লাগার কথা নয়। বুকের মধ্যে দুরুদুরু। যারা আগে এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ ভয়ভীতি দেখিয়েছিলেন—আমেরিকান ইমিগ্রেশন অনেক প্রশ্ন করবে, ছোট ঘরে নিয়ে ইন্টারোগেশন করবে, তারপর ছাড়বে। মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম। আসলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং মুসলিম পাসপোর্ট দেখলেই তারা সন্দেহ করে, ভাবে এরা সবাই ফকিরের দেশ থেকে এসেছে, আর হয়ত ফিরে যাবে না, অবৈধভাবে থেকে যাবে, অথবা ভাবছে এরা লাদেনের শিষ্য, ব্যাগের মধ্যে বোমা নিয়ে এসেছে। ৯/১১ এর মতো আরেকটি ঘটনা ঘটাতে পারে।
আমি লাইনের সামনে চলে এসেছি, আমার সামনে আর মাত্র একজন। তারপর ডাক পড়লো— ‘গুড আফটারনুন’ বলে আমার পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম অফিসারের হাতে। একবার পাসপোর্টের দিকে, আর একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন অফিসার। ভাবলেস, হীন, থমথমে মুখ। পাসপোর্টের পাতা উল্টিয়ে দেখছেন। আমার পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা আছে, আমি ইতিপূর্বে অনেক দেশ সফর করেছি— এটা আমার বড় ভরসা।
পাসপোর্ট দেখা শেষ, এবার প্রশ্ন— ‘কেন এসেছো?’, ‘কতদিন থাকবে?’, ‘এটাই কি প্রথমবার?’ আমি ধীরে-সুস্থ্যে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিলাম— ‘ইন্টারন্যাশনাল বাংলা ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে এসেছি, তিনটি এস্টেটে সাত দিন করে মোট ২১ দিন থাকবো, তারপর ফিরে যাবো আমার দেশে। হ্যাঁ, এটাই আমার আমেরিকায় প্রথম সফর।’
আর কোনো প্রশ্ন হলো না। অফিসার আমার পাসপোর্ট নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে গেলেন। কিছু কথা বললেন। ফিরে এসে পাসপোর্টের পাতায় সীল মেরে ‘ওকে, হ্যাভ এ নাইস ডে’ বলে হেসে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন। আমি ‘থ্যাংকস’ বলে বেরিয়ে এলাম।
এবার লাগেজ ক্লেইম এরিয়ায় এলাম, লাগেজ বেল্ট থেকে আমার লাগেজ নিতে। পাশেই অনেকগুলো ট্রলি লাইন করে রাখা। একটা নিতে এগিয়ে গেলাম, ট্রলি ধরে টানছি, কিন্তু কিছুতেই খুলছে না, পায়ের চাকাটা কোথায় যেন আটকে আছে। খোলার চেষ্টা করছিলাম, তখনই এক কালো নিগ্রো এগিয়ে এলো— ‘হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ইফ ইউ নিড ট্রলি, ইউ হ্যাভ টু পে ওয়ান ডলার।’ বুঝলাম, এক ডলার দিতে হবে। আমার পকেটে খুচরা ডলার ছিল, দিলাম। ডলার দেয়ার পর ট্রলির চাকা খুলে গেল। আমি ট্রলি ঠেলে লাগেজ বেল্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
অবাক হলাম— আমাদের এশিয়া মহাদেশের কোনো এয়ারপোর্টে ট্রলির জন্য টাকা দিতে হয় না, অথচ আমেরিকার এয়ারপোর্টে সামান্য ট্রলির জন্য টাকা দিতে হলো। লাগেজ নিয়ে ট্রলিতে উঠিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমাকে নেবার জন্য কারো আসার কথা ছিল, কিন্তু কাউকে দেখছি না। যাত্রীরা বের হচ্ছে, গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে, আর আমি দাঁড়িয়ে আছি, কেউ আসছে না আমার দিকে।
খুব চিন্তায় পড়লাম। শেষে ফোন সেট বের করে রোমিং চালু করে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহাকে ফোন করলাম— ‘দাদা, আমি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি, কেউ কি আমাকে নিতে আসেনি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, দু’জন গেছে আপনাকে আনতে। আপনি দাঁড়ান, ওরা আপনাকে খুঁজে নেবে।’
দাঁড়িয়ে রইলাম প্রায় ১৫ মিনিট, কিন্তু কেউ আসছে না। মহাবিরক্ত হয়ে আবার ফোন করলাম বিশ্বজিৎ সাহাকে। এবার ফোনই ধরছে না, ভয়েস মেসেজ দিয়ে রেখেছে। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। তাকে বারবার বলেছি, আমি আমেরিকায় প্রথম যাচ্ছি, রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চাইনি। গতকাল রাতেও হংকং থেকে ফোনে বলেছি এয়ারপোর্টে কাউকে রিসিভ করার জন্য পাঠাতে, অথচ এখন কারো দেখা নেই। রাগে, দুঃখে, অপমানে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। আমাকে এখন হোটেলে যেতে হবে। রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সির কিউতে এসে দাঁড়ালাম। এখানে এক নিগ্রো অফিসার এক এক করে যাত্রীদের ট্যাক্সি করে দিতে সাহায্য করছেন। কোনো অসংগতি নেই, কোনো জ্যাম নেই, কোনো হোড়োহুরি নেই। এক এক করে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াচ্ছে, যাত্রীরাও এক এক করে ট্যাক্সিতে উঠে চলে যাচ্ছে।
একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। আমি আমার লাগেজ ট্যাক্সির পিছনে উঠিয়ে নিজে উঠে বসলাম। পকেট থেকে হোটেলের ঠিকানা লেখা কাগজ ড্রাইভারের হাতে দিয়ে লক্ষ্য করলাম, ড্রাইভার বাঙালি। মনে মনে স্বস্তি পেলাম। বললাম, ‘ভাই, আপনার দেশ কোথায়?’ বললেন, ‘কুমিল্লা।’ বললাম, ‘এই হোটেলটা কি আপনি চিনতে পারেন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ট্রেনে যেতে এই হোটেল দেখেছি, চিনতে পারবো।’
‘কতক্ষণ সময় লাগবে?’
‘বেশি না, জ্যাম না থাকলে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো।’
‘ভেরি গুড, চলেন।’
স্বপ্নের দেশ আমেরিকার নিউ ইয়র্ক স্টেট। টেক্সিতে বসে চারদিক দেখে দেখতে যাচ্ছি। চমৎকার রাস্তা, ডানে-বায়ে যেদিকে তাকাই, দিগন্ত পর্যন্ত চোখ যায়। আমেরিকায় নেমে যে বিষয়টি আমার চোখে পড়ল, তা হলো এর দিগন্ত জোড়া বিশালতা। চারদিকে তাকিয়েই বোঝা যায় এই দেশ কতটা বিশাল, সীমাহীন। গাদা গাদি কোনো বিল্ডিং নেই, বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। বিশাল আয়তনের বিত্ত, বৈভব আর প্রাচুর্যের দেশ— সেটা বোঝা যায়। রাস্তাে ট্র্যাফিক জ্যাম নেই।
আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই লং আইল্যান্ড সিটিতে পৌঁছলাম। এখানেই আমাদের হোটেল, লা কুইন্টা। ট্যাক্সি ছেড়ে ব্যাগেজ নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশনে বসে আছে বিশাল দেহী এক যুবতী। আমার রিজারভেশন ছিল। ফরমালিটিজ সেরে রুমে গেলাম। চমৎকার রুম, পছন্দ হলো। কাপড় খুলে লম্বা, হট শাওয়ার নিলাম। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার যাত্রায় শরীর অনেক ক্লান্ত, তাই বিশ্রাম নেওয়ার কথা মাথায় রেখেছিলাম। এরমাঝেই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎদা আমার খাবার নিয়ে হাজির হলেন। এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে না যাওয়ার অপরাধ ভুলাতে এবং খুশি করতে তার এই চেষ্টা। সোলার বক্সে মোড়ানো খাবারের প্যাকেট খুলে মনটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল— গরম ভাত, গরুর মাংস, ভেজিটেবল আর ডাল। সুদূর আমেরিকায় এসে খাঁটি বাঙালি খাবার খেয়ে পেটপুরে খেলাম। তারপর বিছানায় কম্বলের নিচে নিজেকে ঢেলে দিলাম। প্লেনে যাত্রার ক্লান্তি কাটেনি, কিন্তু গোসল সেরে খেয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে অল্প ক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম, ঝক ঝকে বিকেলের রোদ ছড়িয়ে পড়ছে। বাথরুমে ঢুকে চোখ-মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হলাম। ফোন করলাম বিশ্বজিৎদাকে, জানতে পারলাম একই হোটেলে আছেন ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং তার ছেলে, এ প্রজন্মের জনপ্রিয় গায়ক হাবিব ওয়াহিদ। ফেরদৌস ভাইকে ফোন করতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘বস, আপনি কখন এলেন?’ আমি বললাম, ‘দুপুরে এসেছি।’ বললেন, ‘থাকুন, আমি আপনার রুমে আসছি।’ তিনি এলেন। বললেন, ‘একলা একলা বোর হয়ে গেছি, আপনি এসেছেন, এখন সময় কাটবে। আমাদের আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবের অনুষ্ঠান আগামীকাল বিকেলে।’
ফেরদৌস ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হলো। নিচে রেস্টুরেন্টে নেমে চা খেলাম। ভাগনে পাতাকে ফোন দিলাম, সে বলল, ‘মামা, আপনি হোটেলেই থাকেন? আমি আসছি।’ পাতা এলো সন্ধ্যার আগে। ওর সঙ্গে বের হলাম নিউ ইয়র্ক দেখার জন্য। হেঁটে হেঁটে এলাম কাছাকাছি মেট্রো রেল স্টেশনে। টিকেট কেটে ট্রেনে করে এসে নামলাম ম্যানহাটনে।
এই সেই ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্কের মূল সিটি। চারদিকে সমুদ্র, লম্বা লম্বা সাজানো গোছানো চমৎকার ও বিশাল শহর। মোট ১২টি অ্যাভিনিউ (বড় রাস্তা) লম্বা লম্বা এবং ১৩৫টি স্ট্রিট (ছোট রাস্তা) আড়া-আড়ি। ম্যানহাটনে বিশাল বিশাল বিল্ডিং এবং চমৎকার সব আর্কিটেকচার। ফুটপাতে হেঁটে চলছে অসংখ্য মানুষ, নানা জাতি, নানা বর্ণের মানুষ। আমেরিকা আসলে বহু জাতির দেশ। এখানে রাস্তায় দেখা যায় সাদা, কালো, লম্বা, খাটো, নানান রকমের মানুষ। ম্যানহাটনের চারিদিকে সমুদ্র; এর পূর্ব দিকে কুইন্স, দক্ষিণে ব্রুকলিন। দক্ষিণে ব্যাটারি পার্ক সিটির সমুদ্রপাড়ে এসে দাঁড়ালে দেখা যায় লিবার্টি অব স্ট্যাচু, মশাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ম্যানহাটন সিটিতে সেন্ট্রাল পার্ক, ওয়াশিংটন পার্ক, ব্যাটারি পার্ক, টমশন পার্ক, সিটি হল পার্ক, ইউনিয়ন পার্ক সহ মোট ১৭টি পার্ক রয়েছে। পার্কগুলো চমৎকার, সাজানো, সবুজ বৃক্ষে ভরা। ম্যানহাটনকে বলা হয় মিউজিয়ামের শহর। আমেরিকানরা মিউজিয়াম ভালোবাসে। শহরের মধ্যে আছে আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট, মিউজিয়াম অফ সিটি নিউ ইয়র্ক, হুইটনি মিউজিয়াম ইত্যাদি। এসব মিউজিয়ামে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড় দেখি।
রাত হয়েছে। শহরে জ্বলেছে রঙিন বাতি। রাতের ম্যানহাটনের রূপ অন্যরকম, একবারেই স্বপ্নের মতো। টাইম স্কয়ার-এর সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চারিদিক দেখলাম। এই হলো স্বপ্নরাজ্য, সারা পৃথিবীর স্বর্গের দরজা। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়ে গেল।
হারবারের ওপেন স্টেজে কনসার্ট হচ্ছে, হাজার হাজার দর্শক গান উপভোগ করছে। আমরা কিছুক্ষণ থাকার পর পাতাকে বললাম, ‘চলো, টুইন টাওয়ার দেখবো।’ পাতা বলল, ‘টুইন টাওয়ার তো নেই, কিন্তু সেই জায়গাটি আছে।’ আমি বললাম, ‘সেটাই তো দেখবো।’ হেঁটে হেঁটে গেলাম সেই বিখ্যাত জায়গায়। দেখলাম জায়গাটি ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে দেখার জন্য একটি ফাঁকা জানালার মতো জায়গা তৈরি করা হয়েছে, সেখান দিয়েই দেখলাম কনস্ট্রাকশন চলছে। অনেক যন্ত্রপাতি, বিশাল ক্রেন ইত্যাদি দিয়ে দ্রুত নির্মাণ হচ্ছে একটি বিশাল টাওয়ার, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফ্রিডম টাওয়ার।’
৯/১১-এ এখানেই ঘটেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ। আমরা সবাই সেটি জানি, মিডিয়ার কল্যাণে সারা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে সেই ভয়াবহ ঘটনা।
ফিরে এলাম হোটেলে। রাতের খাবার খেতে গেলাম পাশের বিশাল এক ম্যাকডোনাল্ডসে বসে। রুমে ফিরে ফোন করলাম ফেরদৌস ভাইকে, তিনি এলেন। গল্প চলল রাত ১২টা পর্যন্ত, তারপর ঘুম। আমেরিকার প্রথম দিন কাটল এভাবেই।
পরদিন, ১লা জুন ২০০৭। গোসল সেরে নিচে রেস্টুরেন্টে নামলাম ব্রেকফাস্ট করতে। সেখানে দেখা হলো কলকাতার বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে, তিনিও ওপার বাংলার আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নিজেকে পরিচয় করালাম। এরপর রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন কলকাতার বর্তমান প্রজন্মের খুবই জনপ্রিয় গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য।
ওনারা এসেছেন, গতকাল বিকেলে এ উৎসবে যোগ দিতে। আমাদের বাংলাদেশ থেকে এসেছেন শ্রদ্ধেয় স্যার ডঃ আনিসুজ্জামান, প্রবীণ লেখিকা রাবেয়া খাতুন, এ সময়ের খুবই জনপ্রিয় তরুণ লেখক ও দৈনিক প্রথম আলোর উপ-সম্পাদক আনিসুল হক। আগেই বলেছি, গায়ক এসেছেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, তাঁর পুত্র হাবিব ওয়াহিদ, মাহমুদুজ্জামান বাবু— যিনি ‘আমি বাংলার গান গাই’ এই এক গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। আরো এসেছেন আঃ কদ্দুছ বয়াতী।
নিউ ইয়র্কে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবের উদ্বোধন হবে আগামীকাল, ২রা জুন ২০০৭। কাজ না থাকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আজই। আমার বন্ধু আমান-উদ-দৌলাকে ফোন করলাম। এ সেই সাংবাদিক আমান, যিনি ৯০-এর গণ অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক কলাম লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বর্তমানে আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকতার ওপর পড়াশোনা করছেন এবং ‘ওয়ার্ল্ড নিউজ ব্যাংক’ নামে একটি ওয়েব নিউজের সম্পাদনা করছেন।
আমান এলো, ওর সঙ্গে বের হলাম। আমরা প্রথমেই গেলাম জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। বিশাল ভবনের সামনে সারি সারি পতাকা উড়ানো ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড। যতগুলো দেশ জাতিসংঘের সদস্য, ততগুলো পতাকা। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। ঢোকার মুখেই গেটের বাম পাশে একটি চমৎকার ম্যুরাল— একটি মেটালিক গ্লোব, সোনালি রঙের। পৃথিবীর গ্লোবটির মধ্যে ফাটল, ভেতরে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি দেখা যায়। ডানে আর একটি স্ট্যাচু, বিশাল একটি পিস্তল, যার ব্যারেল মোড়ানো। বোঝা যায়, যুদ্ধ বন্ধের প্রতীক এটি।
আমান বলল, সবাই এসে এই বিল্ডিংটাই দেখে যায়, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে না। আসল দেখার বিষয় তো ভেতরে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। ১৩ ডলার করে টিকিট কেটে বসে রইলাম। লবির দেয়াল জুড়ে জাতিসংঘের এ যাবৎ যারা মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের ছবি টাঙানো রয়েছে। শেষ মাথার ছবিটি কফি আনানের, অন্য মাথায় বর্তমান মহাসচিব বান কি মুনের ছবি। আরও কিছু পর্যটক এলো, মোট ১০ জনের একটি গ্রুপ হলাম আমরা। একটি সুন্দরী মেয়ে আমাদেরকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে প্রথমে তাঁর পরিচয় দিলেন, আমাদেরকে জাতিসংঘ ভবন দেখতে আসার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং নিয়মকানুন বললেন। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম। প্রথমেই আমাদেরকে একটি চমৎকার হলরুমে নিয়ে গেলেন। হলরুমটি বেশ বড়, গ্যালারিতে সারি সারি চেয়ার রাখা।
স্টেজের মাঝখানে মহাসচিবের চেয়ার, আর দুই পাশে ৯টি করে মোট ১৮টি চেয়ার ছিল কমিটির সদস্যদের বসবার জন্য। এখানে মিটিং হয়। এর পর এক এক করে ছোট-বড় মোট চারটি হলরুম আমরা দেখলাম। কোন হলে কী ধরনের মিটিং হয়, তার বর্ণনা দিলেন মেয়েটি। হলগুলোর প্রবেশ মুখে, লবিতে দেয়াল জুড়ে ছিল একটি বিশাল তৈলচিত্র, অদ্ভুত সুন্দর। আমাদের শিল্প ভবনের প্রবেশ মুখে এস এম সুলতানের ‘সবাক সচল ইতিহাস’ নামের চিত্রকর্মটির সঙ্গে মিল আছে অনেকটা, তবে এটি তার চাইতেও অনেক বড় এবং সুন্দর।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত সৈনিকদের বেশ কিছু ছবি দেখলাম। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল বাংলাদেশের পতাকার ছবি, খুশি হলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের কয়েকজন সৈন্য মারা গিয়েছিলেন; তাদের লাশ কফিনে ঢেকে বাংলাদেশের পতাকায় মোড়ানো অবস্থায় দেশে পাঠানো হয়েছিল। এ সেই ছবি।
বাইরের বিশাল লবিতে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো থেকে দেওয়া চমৎকার সব উপহার সাজিয়ে রাখা হয়েছে— ভারতের তাজমহল, থাইল্যান্ডের নৌকা, নেপালের মন্দির, আরও কত কিছু। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের কিছুই সেখানে ছিল না। পরবর্তীতে আমরা গিয়েছিলাম ডালাস ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। সেখানেও দেখলাম সারি সারি ঝুলছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। ১৬০টির মধ্যে খুঁজেও পাইনি বাংলাদেশের পতাকা। সেখানে কর্মরত একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সব দেশের শোরুম আছে এবং সেই সব দেশের পতাকা সেখানে ঝুলানো হয়। কিন্তু ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারে বাংলাদেশের কোনো শোরুম নেই।
জাতিসংঘ ভবন থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম মিউজিয়াম দেখতে। বিশাল মিউজিয়াম, অসংখ্য মানুষ মিউজিয়ামে ঢুকছে ও বের হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে আরো বিস্মিত হলাম। বিশাল হলরুমে বিস্ময়কর সব জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে, প্রতিটির নিচে সেটির বর্ণনা। সুনসান নিরবতা বিরাজ করছিল, দর্শনার্থীরা চুপচাপ সব কিছু দেখছিল। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করলাম। সামান্য অংশই দেখেছি; পুরো মিউজিয়াম ভালোভাবে দেখলে হয়ত পুরো মাসই লেগে যাবে।
২রা জুন ২০০৭ তারিখে লং আইল্যান্ড সিটির লাগুটিয়া কলেজের হলরুম ও সুপরিসর চত্বরে শুরু হলো আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ২০০৭। বিকেল ৫টায় ড. আনিসুজ্জামান স্যার উৎসবের উদ্বোধন করলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ও কলকাতার লেখক, গায়করা উপস্থিত ছিলেন। উত্তর আমেরিকার নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিরা উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। মেলা বেশ জমে উঠেছিল। নিউ ইয়র্কে বাঙালিদের মিলন মেলা।
সন্ধ্যার পর হল কানায় কানায় ভরে গেল। শুরু হলো গানের আসর। কলকাতার শ্রীকান্ত আচার্য তাঁর চমৎকার ভরাট গলার গানে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। এর আগে পালাগান গেয়েছেন বাংলাদেশের কুদ্দুস বয়াতি। গান চলল রাত ৯টা পর্যন্ত। এভাবেই কেটেছে বাংলা উৎসবের প্রথম দিন।
দ্বিতীয় দিনেও বিকেল বেলা শুরু হলো উৎসবের অনুষ্ঠানমালা। রবীন্দ্র আলোচনা, নজরুল আলোচনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লেখক-গুণীজনরা বক্তব্য দিলেন। এসব অনুষ্ঠানে দর্শক সংখ্যা খুবই কম ছিল। সন্ধ্যায় শুরু হলো গানের অনুষ্ঠান। আজ প্রথমেই মঞ্চে উঠলেন বাংলাদেশে শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, ‘লিজেন্ড অব বাংলাদেশ’। সুদূর আমেরিকার মাটিতে যখন তিনি গেয়ে উঠলেন ‘আমি বাংলার গান গাই’, শ্রোতারা আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, একসঙ্গে গেয়ে উঠলেন বাংলার গান। বাবু পরপর অনেক গানের আয়োজন শোনালেন তাঁর অদ্ভুত সুন্দর ভরাট গলায়।
এরপর মাইকে ঘোষণা হলো, এবার মঞ্চে আসছেন হাবিব। ‘হাবিব’ নামের ঘোষণা হতেই পুরো হলের শ্রোতারা উল্লাসে ফেটে পড়ল। আমি শুনেছিলাম আমেরিকায় হাবিবের ক্রেজ সম্পর্কে, কিন্তু তা যে এতোটা ব্যাপকতা জানতাম না। হাবিবের গান শুরু হলো। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে হাবিব সত্যিই একজন ব্যতিক্রমী মিউজিক কম্পোজার। তিনি বাংলাদেশের বাউল সম্রাট শাহ আঃ করিমের বিখ্যাত গানগুলো আধুনিক সুরে নতুন মেলোডিতে রূপান্তর করে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলেন শ্রোতাদের।
পরদিন আমরা গেলাম নিউইয়র্কের বাঙালিদের এলাকা হিসেবে খ্যাত জ্যাকসন হাইটসে। এখানেই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহার বইয়ের দোকান রয়েছে— একটি বিশাল দোকান। নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিদের বইয়ের চাহিদা মেটাতে এখানে রয়েছে বিশাল বইয়ের সংগ্রহ। আমাদের সাথে সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন অনন্যা প্রকাশনীর কর্ণধার মুনির আহমেদ, সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমেদ এবং মওলা ব্রাদার্সের মাহমুদুল হক। মুক্তধারার অফিসে গিয়ে দেখা হলো মুনির ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম, এ সময় হাজির হলেন ড. আনিসুজ্জামান স্যার, তরুণ লেখক আনিসুল হক ও কদ্দুছ বয়াতি। চলল আড্ডা। সন্ধ্যার আগেই এক এক করে চলে গেলেন সবাই।
আমি রইলাম বিশ্বজিৎ বাবুর কাছে। তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমিও বেরিয়ে পড়লাম জ্যাকসন হাইটস দেখতে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশি, পাশাপাশি কিছু ভারতীয়ও রয়েছেন। নানা পণ্যের দোকান সাজিয়ে বসেছে বাঙালিরা ও ভারতীয়রা। রাস্তায় লুঙ্গি পরা, মাথায় গোল টুপি দেওয়া ট্র্যাডিশনাল বাঙালিও চোখে পড়ল। খাবারের দোকানগুলোও বাঙালিদের মালিকানাধীন। এক দোকানে ঢুকে পড়লাম বাঙালি দেখে। ভদ্রলোকের বাসা ঢাকার গ্রিন রোডে, আর জ্যাকসন হাইটসে কাপড়ের দোকান আছে। তিনি মাল সংগ্রহ করেন ঢাকা ও চায়না থেকে। ব্যবসা ভালোই করছেন। নিউইয়র্কের দোকানগুলোতে লক্ষ্য করেছি চীনা পণ্যের আধিক্য। চীন আস্তে আস্তে বিশ্ববাজার দখল করছে তাদের পণ্য দিয়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমেরিকান সরকার চীনকে ঠেকাতে পারছে না।
ফিরে গেলাম বিশ্বজিৎ বাবুর মুক্তধারা অফিসে। রাতে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন একটি বাঙালি রেস্টুরেন্টে। ভাত, পাবদা মাছ, গরুর মাংস, সবজি ও ডাল দিয়ে রাতের ডিনার সারালাম। লক্ষ করলাম, ওই রেস্টুরেন্টে আমাদের ঢাকার বাঙালি মেয়েরা কাজ করছে। অনেক রাত পর্যন্ত বিশ্বজিৎ বাবুর গাড়ি আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিল। আগামীকাল ভোর পাঁচটায় রওনা দেব ডালাসের উদ্দেশ্যে।