Logo

ফিচার

লোভের কাছে নীতি হারালে সর্বনাশ নিশ্চিত

Icon

রিয়াজুল হক

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ২০:৫২

লোভের কাছে নীতি হারালে সর্বনাশ নিশ্চিত

রিয়াজুল হক

‘আরো চাই, আরো চাই’—এই চাওয়ার শেষ কোথায়? মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লোভের জন্ম হয়। লোভ মানেই অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার বাসনা, যার জন্য আমরা কখনো বিবেক বিসর্জন দিই। লোভ কেবল ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকেও গ্রাস করতে পারে। আজকের বিশ্বে, বিশেষ করে আমাদের সমাজে, অতিরিক্ত লোভ যেন নীরব এক মহামারি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লোভ একসময় মানুষের একান্ত দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন সেটা যেন ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। কে কত সম্পদে বলীয়ান, কে কত দ্রুত ধনী হতে পারছে— তার উপর ভিত্তি করে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হচ্ছে। আর এই প্রতিযোগিতার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে লোভ। আমরা যে সমাজ গড়ে তুলছি, তাতে সততা নয়, সফলতার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে অর্থ।

লোভের কারণে মানুষ নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেয়। প্রতারণা, দুর্নীতি, মিথ্যা বলা— এমনকি আত্মীয়-পরিজনের সাথেও বেঈমানি করে বসে। ব্যবসায়ে অতি লাভের আশায় ভেজাল পণ্য তৈরি করা হয়। আর সিন্ডিকেট তো আছেই। চাকরিতে সদ্য যোগদান করা ব্যক্তিটি স্বপ্ন দেখে দ্রুত বাড়ি-গাড়ি করার, যা তাকে অবৈধ পথে টেনে নেয়।

লোভ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কখনো লোভ পূরণ না হলে হতাশা, অবসাদ, আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত আসে। আবার অনেক সময় লোভ পূরণ হলেও সেই সুখ স্থায়ী হয় না, কারণ মন তখন আরেকটি নতুন লোভ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ এক দুষ্টচক্র, যার কোনো শেষ নেই।

পরিবারের সদস্যদের মাঝেও লোভের আগুন লাগে। জমিজমা, উত্তরাধিকার, অর্থ-সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই দাঁড়িয়ে যায়। সম্পদের জন্য বাবা-মায়ের কবর দিতেও বিলম্ব করা হয়। আর এসবের পেছনে অর্থ-সম্পদের প্রতি অসুস্থ আসক্তি অন্যতম কারণ।

সমাজের বৃহৎ পরিসরেও লোভের কুফল স্পষ্ট। বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়মের পেছনে এই অতৃপ্ত চাহিদা বড় দায়ী। আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে নৈতিকতা কমে আসছে।

অতিরিক্ত লোভ কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি সমাজে চরম বৈষম্য তৈরি করে। ধনীরা আরও ধনী হয়ে ওঠে, দরিদ্ররা হয় আরও দরিদ্র। এই বৈষম্য আবার জন্ম দেয় অসন্তোষ, সহিংসতা, অপরাধপ্রবণতা। ফলে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে, শান্তি নষ্ট হয়।

একটা সমাজ যত বেশি লোভ দ্বারা চালিত হয়, ততই তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও দেখা যায়— এক শ্রেণির মানুষ দেশের সম্পদ লুট করে বহির্বিশ্বে পাচার করছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।

লোভ স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি হলেও এর লাগাম টেনে ধরা জরুরি। ধর্ম, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সবখানে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে যে মানুষের আসল সম্পদ তার নৈতিকতা, তার চরিত্র। নতুন প্রজন্মকে প্রাচুর্য নয়, শান্তি খোঁজার শিক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন ও শাস্তির যথাযথ প্রয়োগ, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। তবে বড় কাজটি ব্যক্তিকেই করতে হবে। কারণ অর্থপ্রাচুর্যের পেছনে ছুটে যদি নৈতিকতা হারিয়ে ফেলি, তবে সেই অগ্রগতি কেবল ধ্বংসই ডেকে আনবে।

লেখক : রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর