
আপনি কি কখনো ঢাকার আকাশপানে তাকিয়ে দিগন্ত দেখেছেন? মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোই আজ এই শহরকে দিয়েছে ‘মেগাসিটি’ নামে পরিচিতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই সবকিছু কিভাবে শুরু হলো? প্রথম পদক্ষেপ কে নিয়েছিল? বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ কারা করেছিল? উত্তরটি অনেকেরই জানা— কনকর্ড।
যদি আপনি ঢাকার উত্থান শুরু থেকেই দেখে থাকেন, তবে এই নামটি নিশ্চয়ই আপনার চেনা। আর যদি আপনি শুধুমাত্র পরবর্তী গল্প দেখেছেন, তবে এখনই সময় শুরুটা জানার। এই সবকিছুরই ভিত্তি— কনকর্ড। বাংলাদেশি শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কনকর্ড গ্রুপ পূর্ণ করল তার ৫০ বছর। যার গল্প বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
১৯৭৩ সাল, স্বাধীনতার দু’বছর পর। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বেশকিছু সেতু পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে কনকর্ড তাদের পথচলা শুরু করে। সময়টা ছিল খুবই কঠিন। জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়াস। পাশাপাশি চলছিল দেশ পুনঃনির্মাণের কাজ। কনকর্ড তাদেরই মধ্যে অন্যতম একটি নাম— যা দেশ পুনঃনির্মাণের শুরু থেকেই জড়িয়ে আছে। সেই নীরব, দৃঢ় সংকল্পের প্রচেষ্টায় নগর ও মানুষকে আবার সংযুক্ত করার সূচনা তখনই হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে জনাব এস.এম. কামাল উদ্দিনের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আজও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
একটি জাতির সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠানের বেড়ে ওঠার জন্য যদি উদাহরণ প্রয়োজন হয়, তবে কনকর্ড গ্রুপ হবে সেই নাম। বন্দরের পুনঃনির্মাণ, কারখানা ভবন ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কনকর্ড। আশির দশকে ঢাকায় প্রথম উচ্চ-অট্টালিকা— ২০ তলা বিশিষ্ট বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ভবনের নির্মাণ শুরু হয় মতিঝিলে। এটি ছিল নতুন রাজধানীর ভাবমূর্তির একটি ঝলক।
কিন্তু যদি কোন প্রকল্পে কনকর্ডের ইতিহাস সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়, সেটি হলো ১৯৮২ সালে সাভারে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। বিশিষ্ট স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নকশায় এবং কনকর্ডের নির্মাণে মাত্র ৮৯ দিনে নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ। অনেকের অজানা, এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কনকর্ডের অবদান— যা তাদের গল্পের প্রথম পাতায় স্থান পায়।
টেকসই উন্নয়ন যখন এখনকার মতো স্বাভাবিক অগ্রাধিকার হয়ে ওঠেনি, তখন থেকেই তারা ভবন নির্মাণের পদ্ধতিকে বদলে দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ব্রিক বা ব্লক চালু করে, যা প্রচলিত অগ্নিগর্ভ ইটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তখনকার সময়ে চিমনিভিত্তিক ইটভাটা আমাদের পরিবেশ দূষিত করছিল এবং জনস্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে কনকর্ড একটি উন্নত ও বাস্তবমুখী পথ বেছে নিয়েছিল। তারা পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি ইট ব্যবহার করে দেশের প্রথম নির্মাতা হিসেবে পরিবেশবান্ধব নির্মাণের প্রচলন শুরু করে। আজ, যখন সরকারের পক্ষ থেকে ধীরে ধীরে ইটভাটার ইট ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কনকর্ডের সেই সময়োচিত সিদ্ধান্ত নতুন করে সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছে। কনকর্ড এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ গ্রিন ব্লক উৎপাদক ও ব্যবহারকারী।
কনকর্ডের উল্লেখযোগ্য প্রকল্পসমূহ
জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সাভার
সিঙ্গটেল টাওয়ার, সিঙ্গাপুর
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (৩য় টার্মিনালসহ)
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, চট্টগ্রাম
আইডিবি ভবন, ঢাকা
জাতীয় ইনডোর স্টেডিয়াম, মিরপুর
ফ্যান্টাসি কিংডম, আশুলিয়া
পুলিশ প্লাজা কনকর্ড, গুলশান
জীবন বীমা টাওয়ার, মতিঝিল
শিল্প ব্যাংক ভবন, মতিঝিল
জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল
লেক সিটি কনকর্ড (প্রথম স্যাটেলাইট টাউনশিপ), খিলক্ষেত
পেট্রোবাংলা ভবন, কাওরান বাজার
ব্রিটিশ হাই কমিশন অফিস, ঢাকা
বাংলাদেশে নির্মাণ ও উন্নয়নের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে কনকর্ডের এইসব প্রকল্প অনেক অনেক নির্মাণের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য নামমাত্র।
রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের মাধ্যমে কনকর্ড ১০ হাজারের বেশি পরিবারকে বাসস্থান নির্মাণ করে দিয়েছে। এই পরিবারগুলোর জন্য প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট কেবল আবাসন নয়— জীবনেরই অংশ, যেখানে সন্তানরা বড় হয়, ঈদ ও জন্মদিন পালিত হয় এবং প্রতিবেশীরা পরিণত হয় বন্ধুত্বে। কনকর্ড শুধু আবাসন দেয়নি, দিয়েছে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার এক স্থায়ী মাধ্যম।
২০০২ সালে বাংলাদেশে প্রথম বিশ্বমানের থিম পার্ক ‘ফ্যান্টাসি কিংডম’ উদ্বোধনের মাধ্যমে কনকর্ড এক নতুন আনন্দ ও কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। অসংখ্য শিশুর জন্য এটি ছিল তাদের প্রথম রোলার কোস্টার অভিজ্ঞতা। পরিবারের জন্য এটি হয়ে ওঠে স্মৃতি তৈরির স্থান। চট্টগ্রামে কনকর্ড ফয়’স লেক গড়ে তোলে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ করে অতিথিদের জন্য আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
প্রতিষ্ঠান যেমন বেড়ে উঠেছে, তেমনই প্রসারিত হয়েছে তার স্বপ্ন। প্রসারিত হয়েছে ব্যবসায়িক পরিধি— নির্মাণ সামগ্রী থেকে পর্যটন, আর্কিটেকচার থেকে যোগাযোগ পর্যন্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কনকর্ড কাজ করেছে একই মূল্যবোধ নিয়ে: উদ্ভাবন, গুণমান, এবং দায়িত্ব। আজ কনকর্ড বাংলাদেশের সবচেয়ে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। শুধু এটি কী নির্মাণ করে তার জন্য নয়, বরং এর অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং দৈনন্দিন জীবনে অবদানের জন্যই এই স্বীকৃতি।
১০ জুলাই কনকর্ড তাদের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে স্মরণীয় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শুভ উদ্বোধন করেন কনকর্ড গ্রুপের ভাইস চেয়ারপারসন মিসেস ফারিদা কামাল।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব শাহরিয়ার কামাল, পরিচালক (কমপ্লায়েন্স) মিস নাজিয়া করিশমা কামালসহ কনকর্ডের বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সারা দেশ থেকে আগত কর্মীরা।
এই দিনটি ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ছিল গল্প, আনন্দ, কর্মব্যস্ততা এবং আত্মানুভূতির এক মিলনমেলা। কর্মীরা দিনব্যাপী এই স্মরণীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে কনকর্ড পরিবার গড়ে তোলার পেছনের মানুষদের সম্মান জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে কনকর্ড সবসময় কর্মীদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। এই বিশেষ দিনে কনকর্ডের নেতৃত্ব পুনর্ব্যক্ত করে যে, কর্মীদের উন্নয়ন ও সুস্থতাই তাদের মূল ভিত্তি। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানায়, বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোর পরিধি আরও বাড়ানো হবে এবং নতুন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যা কর্মীদের আরও অনুপ্রাণিত করবে।
এই নতুন অধ্যায়ে পা দিয়ে কনকর্ড আগামীর পথচলায় আরও অনেক কিছু করতে চায় তাদের কর্মীদের জন্য— যাঁরা সবসময় এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূলে ছিলেন।
৫০ বছর পূর্ণ হওয়া কনকর্ডের জন্য একটি বিশেষ অর্জন। তবে দেশের উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ বছরের এই যাত্রা সত্যিই অসাধারণ। বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতি ছিল তাদের পূর্ণ আন্তরিকতা। সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার জন্য কনকর্ড পেয়েছে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার।
কিন্তু তারপর?
পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য উন্মোচিত হবে নতুন চ্যালেঞ্জ। কনকর্ডের অঙ্গীকার আগের মতোই রয়ে যাবে— সবার জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। পরবর্তী ৫০ বছরের পথচলা শুরু এখনই!
এমডিএ/এইচকে