
প্রতীকী ছবি (এআই দিয়ে তৈরি)
কল্পনা করুন, পুরান ঢাকার এক গলির মোড়ে ছোট্ট একটি দোকান—পেছনে কাঠের তাক, সামনে সাজানো মসলিনে মোড়া হ্যান্ডমেইড সাবান। দোকানদার রিয়াজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন—প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে তাঁর সাবান দেখে, গন্ধ নেয়, দাম জিজ্ঞেস করে।
তিনি দাম বলেন। সাথে আরও বলেন—‘এই সাবান স্কিনের জন্য ভালো, এখন অফারও আছে—দুইটা কিনলে একটা ফ্রি!’
অন্যদিকে শহরের অন্যপ্রান্তে, এক তরুণী ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে ‘সাবানে ঐতিহ্য’ নামে পেজ খুলে ভিডিও শেয়ার করছেন—যেখানে তিনি বলছেন, ‘আমার মায়ের হাতের পুরোনো রেসিপি দিয়ে বানানো এই সাবান শুধু পরিষ্কার রাখে না, আমার শেকড়ের গন্ধও মনে করিয়ে দেয়…’
দুইজনই আসলে একই পণ্য তুলে ধরছেন। কিন্তু একজন চেষ্টা করছেন সরাসরি পণ্যটি বিক্রি করতে, আর অন্যজন তৈরি করছেন একটি অনুভূতি। বলছেন একটি গল্প। গড়ে তুলছেন বিশ্বাস ও সম্পর্ক।
এই দুই ভূমিকা—একজন প্রোডাক্ট প্রমোটার, অন্যজন ব্র্যান্ড প্রমোটার। শব্দদুটো একই সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও পার্থক্য সবসময় করতে পারি না। কিন্তু একটু জানতে চেষ্টা করলেই বোঝা যায়, এরা একে অপরের সমান্তরাল নয়—বরং একে অপরকে সম্পূর্ণতা দেয়।
আজকের আলোচনাটি এই দুটি পথ—প্রোডাক্ট প্রমোশন বনাম ব্র্যান্ড প্রমোশনের পার্থক্য, কার্যকারিতা এবং প্রয়োগযোগ্যতা—এই বিষয়ে।
আজকের বাজারে প্রমোশন শব্দটা শুনলেই আমরা অনেকেই পণ্যের অফার, ছাড় কিংবা ক্যাম্পেইনের কথা ভাবি। কিন্তু 'ব্র্যান্ড প্রমোশন' আর 'প্রোডাক্ট প্রমোশন' কাজে যেমন আলাদা, প্রভাবেও আলাদা, এমনকি লক্ষ্য-গন্তব্যেও এক নয়।
মূল পার্থক্য
প্রোডাক্ট প্রমোটার নির্দিষ্ট পণ্য নিয়ে কাজ করেন। পণ্যের বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার, দাম, ডিসকাউন্ট এবং বাজারে উপস্থিতি তুলে ধরাই তার কাজ। উদ্দেশ্য স্পষ্ট— বিক্রি বাড়ানো।
ব্র্যান্ড প্রমোটার পুরো ব্র্যান্ডের ইমেজ, দর্শন, মান এবং মানুষের মনে আস্থা ও ভালোবাসা তৈরি করার দায়িত্বে থাকেন। তিনি কেবল পণ্য নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেন এবং ভোক্তা বা ক্রেতার সাথে স্থায়ী এক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
ট্যাগলাইন : ব্র্যান্ড প্রোমোশনের মূল কথাকে এক বাক্যে এরকম ট্যাগ লাইনে বলা যেতে পারে— 'পণ্য বিক্রির আগে পণ্যের বিশ্বাস তৈরি করুন, সেটাই টেকসই ব্যবসার চাবিকাঠি।'
প্রোডাক্ট প্রমোশনের কাজ কী?
একজন প্রোডাক্ট প্রমোটার—
- নির্দিষ্ট পণ্যের বৈশিষ্ট্য, দাম, ডিসকাউন্ট ইত্যাদি তুলে ধরেন।
- কাস্টমারকে 'এখনই কিনুন'–এই চাহিদা তৈরি করেন।
- বিক্রির জন্য তথ্যভিত্তিক ও অফারনির্ভর কনটেন্ট ব্যবহার করেন।
উদাহরণ
ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে 'আজ অর্ডার করলেই ৩০% ছাড়' এমন পোস্ট, যেখানে প্রোডাক্টের দাম, ছবি ও ডেলিভারির তথ্য স্পষ্টভাবে দেওয়া থাকে।
ব্র্যান্ড প্রমোশন কাকে বলে?
একজন ব্র্যান্ড প্রমোটার—
- ব্র্যান্ডের দর্শন, সংস্কৃতি, ভিশন তুলে ধরেন।
- কাস্টমারের মনে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ও ভালোবাসা তৈরি করেন।
- ব্র্যান্ড স্টোরি ও কাহিনি দিয়ে মানুষের সঙ্গে আবেগি সম্পর্ক তৈরি করেন।
উদাহরণ
‘শিল্পপুরাণ’ শিরোনামে একটি ক্যাম্পেইন—যেটি বাংলার সূচিশিল্পের প্রাণবন্ততা তুলে ধরে এবং ব্র্যান্ডের প্রতি এক ধরনের মমত্ব তৈরি করে।
কেন এই পার্থক্য জানা জরুরি?
- লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়ক : প্রোডাক্ট প্রমোটার তাৎক্ষণিক বিক্রিতে সাহায্য করেন, আর ব্র্যান্ড প্রমোটার ভবিষ্যতের বিশ্বাস গড়েন।
- বাজেট ও রিসোর্স বরাদ্দ সহজ হয় : ছোট পরিসরে ডিসকাউন্ট-ভিত্তিক প্রোডাক্ট প্রমোশন কার্যকর, কিন্তু বড় ব্র্যান্ড তৈরির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন।
কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য
- প্রোডাক্ট প্রমোশন : তথ্য ও অফার-ভিত্তিক।
- ব্র্যান্ড প্রমোশন : অনুভব, গল্প, পরিচিতি-ভিত্তিক।
একটি দৃষ্টান্তমূলক ভাবনা
- ‘উপরে ওঠার জন্য প্রতিটি সিঁড়ি পার হতে হয়। একটি ধাপ বাদ দিয়ে উপরে উঠতে গেলে বড়সড় হোঁচট খেতে হয়।’
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য কৌশলগত পরামর্শ
১. স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে কনটেন্ট তৈরি
- পহেলা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গাপূজা ইত্যাদি উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্র্যান্ডের গল্প বলুন। এতে স্থানীয় সংযোগ গড়ে ওঠে।
উদাহরণ : বিভিন্ন উৎসবে আমরা দেখি বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় সংস্কৃতির বিষয় তুলে ধরে বিজ্ঞাপন বানায়। 'মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ', 'আপনজনের কাছে যাওয়া' 'দেশি নকশীকাঁথা' জাতীয় আবেগ নিয়ে বানানো হয় বিজ্ঞাপন। এসব মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।
২. সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্র্যাটেজি নির্ভর প্রচার
- ফেসবুক লাইভ।
- ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট।
- ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং।
উদাহরণ : প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর ক্যাম্পেইন পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে তাদের ব্র্যান্ড প্রচার সফল হয়েছে।
৩. ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি শক্তিশালী করুন
- লোগো, রঙের থিম, প্যাকেজিং—সব কিছুতেই ঐক্য রাখুন।
- পোস্টার, ফ্লায়ার—বিশেষ করে গ্রামীণ বাজারে এখনও কার্যকর৷
৪. CSR (Corporate Social Responsibility) কার্যক্রম
- CSR হলো একটি প্রতিষ্ঠানের সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা।
উদাহরণ : ধরা যাক, কর্পোরেট কোম্পানি বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান 'দেশ আমার, দায়ও আমার' জাতীয় শ্লোগানে ক্যাম্পেইন চালালে সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ওই ব্র্যান্ড মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
৫. ব্র্যান্ড সহযোগিতা ও পার্টনারশিপ
- স্থানীয় ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে কাজ করুন।
- তুলনামূলক ছোট উদ্যোক্তারা একে অপরের পণ্য তুলে ধরতে পারেন। একসাথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সুফল পাওয়া যায়। অন্য উদ্যোক্তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে সহযাত্রী হিসেবে বিবেচনা করুন। তাতে সবারই ভালো হবে।
উদাহরণ : পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ডকেই আমরা দেখেছি অন্য বিখ্যাত ব্র্যান্ডের সাথে সহযোগিতা করে বা মিলিত হয়ে নিজেদের ব্র্যান্ডের ভ্যালু ও বাজারে প্রবেশযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
৬. গ্রিন-ব্র্যান্ডিং ও টেকসই প্রচারণা
- ইকো-ফ্রেন্ডলি প্যাকেজিং।
- পুনর্ব্যবহারযোগ্য কনসেপ্ট।
- পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ।
বাস্তবতা : বাংলাদেশে পরিবেশ সচেতন ক্রেতা শ্রেণি বাড়ছে এবং গ্রিন ব্র্যান্ডিং গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
বাস্তবায়নের ধাপ
ধাপ কর্মপরিকল্পনা
- আপনি কোন অভিজ্ঞতা দিতে চান—পণ্যের না ব্র্যান্ডের? সেটি নির্ধারণ করুন।
- কনটেন্ট ও ভিজ্যুয়াল পরিকল্পনা : রঙ, শব্দ, গঠন তৈরি করুন।
- মাল্টি-চ্যানেল প্রচার : ডিজিটাল + প্রিন্ট + অফলাইন।
- মাপা ও অপ্টিমাইজ : CTR, কনভার্সন রেট দেখুন, AD রিফাইন করুন।
- CSR বা পার্টনারশিপ : কমিউনিটি বা NGO–র সাথে কাজ করুন।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে হাজারো কনটেন্টের ভিড়ে আপনার ব্র্যান্ডের সত্যিকারের কণ্ঠস্বরকে আলাদা করে তোলা কঠিন।
একজন ব্র্যান্ড প্রমোটার শুধু ডিজাইন বা অফার নয়, একটি জীবন্ত চরিত্র গড়ে তুলতে পারেন—যে চরিত্র ক্রেতার অনুভূতির সাথে মিশে যায়। ক্রেতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সেক্টরভিত্তিক উদাহরণ
- ঘরোয়া খাবারের উদ্যোগ : ‘মায়ের হাতের স্বাদ’—এরকম গল্পধর্মী আবেগি ব্র্যান্ডিং অনেক শক্তিশালী হতে পারে।
- কাস্টম হস্তশিল্প : ‘নিপুণ হাতে তৈরি দেশি পণ্য’— এ জাতীয় প্রচারে মানুষ নিজের সংস্কৃতিকে খুঁজে পায়।
দুইয়ের সঠিক সমন্বয়ই শক্তি
- কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির জন্য প্রোডাক্ট প্রমোশন দরকার—তাতে বাজারে উপস্থিতি তৈরি হয়।
- কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে, ব্র্যান্ড প্রমোশন অপরিহার্য—এতে ভালোবাসা ও আস্থা গড়ে ওঠে।
- একটা সময়ের পর বিক্রি আর শুধু অফার দিয়ে হয় না—আস্থা দিয়েই হয়।
আমি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে এই কথাগুলো লিখেছি, যা আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। কথাগুলোর সাথে সবাই একমত নাও হতে পারেন।
তবে আমার বিশ্বাস, আমরা স্রোতের তালে গা ভাসিয়ে চলতে চলতে ভুলে যাচ্ছি—আসলে আমাদের কী করা উচিত।
বিক্রির আগে বিশ্বাস গড়ুন। কারণ যেখানেই বিশ্বাস, সেখানেই ব্র্যান্ড।
লেখক : হস্তশিল্প উদ্যোক্তা; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শিল্পপুরাণ